মিলি
ভারতীয় সমাজ নারীদের জন্য এখনও চরম বর্বর সমাজ। আইনগতভাবে এখানে নারীদের অনেক অধিকার থাকলেও বাস্তবে তাদের মর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ও মানুষের মতো।এদেশে এখনো পশ্চাদপদ সামন্তবাদী মূল্যবোধের প্রাধান্য। আজও, ভারতের অধিকাংশ নারীকে তাদের সমগ্র জীবন অতি সংকীর্ণ বৃত্তের মধ্যে কাটাতে হয়। বাড়ি থেকে শুরু করে শিক্ষা, চাকরিসহ সমাজের প্রতিটি অংশে তাদের শারীরিক ও মানসিক হিংসার শিকার হতে হয়। নিজের ইচ্ছায় প্রেম করা থেকে শুরু করে জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়া, প্রতিটি ছোটখাটো অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে হয়, অবাধে ঘর থেকে বের হওয়া, নিজের ইচ্ছামতো পোশাক পরা, চাকরি করা ইত্যাদি।পছন্দের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার জন্য সম্মানের নামে খুন করা হয় আবার কখনও যৌতুকের নামে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। প্রতিদিন সংবাদপত্র নারী ধর্ষণের খবরে ভরপুর।
ভারত সরকার দ্বারা প্রকাশিত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর একটা রিপোর্ট অনুসারে, ২০২২ সালে মহিলাদের বিরুদ্ধে মোট ৪.৪৫ লক্ষ মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল, যা ২০২১ এবং ২০২০ সালের তুলনায় বেশি। এই অপরাধের তালিকায় স্বামী বা আত্মীয়দের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতা যেমন ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, অপহরণ ইত্যাদি অপরাধ অন্তর্ভুক্ত।
ভারতের অকার্যকর পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থাই এইসব অপরাধ নথিভুক্ত করা হয়েছে। নারীর বিরুদ্ধে অধিকাংশ অপরাধই সমাজের নজরে পড়ে না। এসব পরিসংখ্যান মানবতাকে লজ্জায় ফেলে দেয়, কিন্তু দেশের শাসক ও আমলাতন্ত্র এসব তথ্য আড়াল করার জন্য প্রতিদিন নতুন নতুন অজুহাত বের করে। আর এর থেকেও বড় প্রহসন হলো ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বলছে, এই পরিসংখ্যান বৃদ্ধির মানে এই নয় যে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে, আসলে দেশে অপরাধ রেকর্ডিং ব্যবস্থার উন্নতির কারণে এই পরিসংখ্যান বেড়েছে। এমন দুর্বল বিচার ব্যবস্থা থেকে নারীরা কী কোন রকম নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার আশা করতে পারে? এই রিপোর্ট অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে, নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের্৩৪,৭৩১টি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল ২০২২ সালে। ভারতে নারীর প্রতি অত্যাচারের অধিকাংশই গোপন থাকে।এখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, এই পরিসংখ্যানে বৈবাহিক ধর্ষণের পরিসংখ্যান অন্তর্ভুক্ত নয়। ভারতীয় আইন বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে অস্বীকার করে। সংবিধানের ৩৭৫ অনুচ্ছেদ বৈবাহিক ধর্ষণকে বিধিবদ্ধ অপরাধের বিভাগ থেকে বাদ দিয়েছে। একটি সরকারি দপ্তর দ্বারা করা সার্ভে অনুসারে, ১৮-৪৯ বছর বয়সী ৮৩ শতাংশ মহিলা যারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা তাদের স্বামীকে এর জন্য দায়ী করেছেন। এর সাথে বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কুফলের এক অদ্ভুত মিশ্রণও তৈরি হয়েছে। পুঁজিবাদের আবির্ভাবের সাথে সাথে নারীর দাসত্বের রূপও বদলায়। এই সমাজব্যবস্থায় নারীর শরীরকে বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। নারীর অস্তিত্বকে পুরুষের ভোগের বস্তুতে সীমাবদ্ধ রাখা পুঁজিবাদী সংস্কৃতির লক্ষণ। নারীদের দেহ ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের বাজারের জিনিসপত্র বিক্রির জন্য। সিনেমা, গান ইত্যাদিতে নারীকে মানুষ হিসেবে দেখানো হয় না, শুধুমাত্র উপভোগ করার মতো সুন্দর দেহ হিসেবে দেখানো হয়। তা ছাড়া পর্নোগ্রাফি পুঁজিবাদী সংস্কৃতির সবচেয়ে জঘন্য রূপ। এই সমাজে ছোট বাচ্চাদেরও পর্নোও অ্যাক্সেস রয়েছে, যা নারীর বিরুদ্ধে অপরাধকে আরও উৎসাহিত করছে। সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী নারী-বিরোধী মূল্যবোধের দমবন্ধ এই ব্যবস্থাকে ভাঙতে সাংস্কৃতিক ও আদর্শগত স্তরে তীব্র সংগ্রামের প্রয়োজন রয়েছে।