এনডিটিভি দখল করার জন্য আদানির প্রচেষ্টা হল রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক শক্তির দ্বারা পরিকল্পিতভাবে চালানো তথ্য যুদ্ধের আরেকটি রূপ।
তথ্যের উৎসের ওপর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ এই যুদ্ধ জয়ের মূল মন্ত্র। তথ্যকে তাদের স্বার্থের জন্য মোচড় দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা অর্জনের জন্য, অনেক সময় ভিত্তিহীন, সত্যের সাজে সেগুলি মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য আরও বেশি করে তথ্যের উত্স দখল করা প্রয়োজন।
সুতরাং, আশ্চর্যের কি আছে যে আজকের দিনে ভারতের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার একটি বড় অংশ দু-একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে এবং তাদের চ্যানেলগুলো এমন ন্যারেটিভ তৈরি করে চলেছে যা এদেশের রাজনীতি ও সাধারণ মানুষের চিন্তাধারাকে কলুষিত করতে এবং বিকৃত করতে কোন কসুর রাখেনি।
কোনো দেশের সম্পদ দখল করতে হলে শুধু সে দেশের রাজনীতি নিয়ে কোনো কাজ হবে না। সেখানকার নাগরিকদের মানসিক অভিযোজনও সমান গুরুত্বপূর্ণ, তা না হলে রাজনীতিকে তাদের অনুকূলে রাখা সম্ভব হবে না। নাগরিকদের মানসিক অবস্থার জন্য দুটি জিনিস আবশ্যক। প্রথমত, সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রবেশাধিকারে নিরুৎসাহিত করা এবং দ্বিতীয়ত, এই বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শিক্ষিত সদ্য ধনী শ্রেণিকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া।
আমাদের দেশের রাজনীতি কর্পোরেট শ্রেণীর দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য অর্জনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এবং এই বিশৃঙ্খল পরিবেশে যে ক্ষমতা কাঠামো রূপ নিয়েছে তা ইতিহাসের সবচেয়ে গণবিরোধী শক্তি হিসেবে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
এতদসত্ত্বেও, ভারতের মিডিয়া, বিশেষ করে আঞ্চলিক মিডিয়া, তার আগুন আঁচ হারিয়ে ফেলেছে এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য রাজনৈতিক প্রচারণার একটি মোহরা হয়ে উঠেছে, জনগণের কণ্ঠস্বর হওয়ার নৈতিক বাধ্যবাধকতার বাইরে গিয়ে, কিন্তু তবুও, আশা বেঁচে আছে। .এই আশা কোথা থেকে আসে? এই আশার জন্ম দিয়েছে প্রযুক্তির আশ্চর্যজনক বিকাশ এবং সম্প্রসারণ। প্রযুক্তি তার জন্মদাতারও দাসত্ব করে না। সে যার হাতে যায় তারই হয়।
প্রযুক্তির এই প্রসারই ‘সিটিজন জার্নালিজম’ ধারণার জন্ম দিয়েছে। তথ্যের আদান-প্রদানে নাগরিকদের ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক অংশগ্রহণ এর একটি স্বাভাবিক ফলাফল এবং এটি কর্পোরেটের বৃহত্তর উদ্দেশ্যগুলির প্রতিবন্ধকতার রূপ নিচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাবের সাথে, নাগরিক সাংবাদিকতাও মূলধারার মিডিয়ার স্টেরিওটাইপগুলিকে চ্যালেঞ্জ করছে।
পৃথিবী দ্রুত বদলে যাচ্ছে এবং ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা এই পরিবর্তনশীল বিশ্বকে প্রত্যক্ষ করছি।
ডিজিটাল মিডিয়া সমস্ত অপশক্তির বিরুদ্ধে একটি কার্যকর অস্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যা মেইন স্ট্রিম মিডিয়া তৈরি করে চলেছে।
এর প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। যদিও সরকার ডিজিটাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টায় আইনের আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে, যদিও এর অপব্যবহারও হচ্ছে, এটি আমাদের আশ্বস্ত করে যে সত্যকে নির্ণায়কভাবে নেপথ্যে ঠেলে দেওয়া যায়না এবং বলার সাহস থাকলেডিজিটাল মিডিয়া সত্যকে জনগণের কাছে নিয়ে আসার জন্য একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠতে পারে বা তৈরিও হচ্ছে।যেমন মনে করা হচ্ছে একজন রবীশ কুমারের কণ্ঠকে স্তব্ধ করার জন্য এনডিটিভি দখল করার সমস্ত অনুশীলন করা হয়েছে। তবে এই অধিগ্রহণকে বাজারের ভাষায় বলা হচ্ছে ‘বিদ্বেষমূলক দখল’। অর্থাৎ ব্যবস্থাপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, বাজারের নিয়মের ছদ্মবেশে, তার অর্থনৈতিক শক্তির জোরে একটি সংস্থার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
রবিশ কুমারও চ্যানেল থেকে পদত্যাগ করেছেন যা তাকে করতেই হোত
কিন্তু, এটা কি রবিশের কণ্ঠকে দমিয়ে দেবে?
না তা নয় কারণ, যতক্ষণ তার কথা বলার সারবত্তা থাকবে, সে যেখান থেকে কথা বলবে, লাখ লাখ মানুষ তার কথা শুনতে যাবে।
এনডিটিভি থেকে রবীশ কুমারের বহিষ্কার একটি ট্র্যাজেডি যা রবিশের ব্যক্তিগত জীবনে যতটা প্রভাব ফেলবে তার চেয়ে বেশি এনডিটিভির বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রভাবিত করবে।তিনি এবং তার প্রাইম টাইম চ্যানেলের পরিচয় হয়ে উঠেছিল। কর্পোরেট সংস্কৃতির অন্ধকারে এই পরিচয় কোথাও হারিয়ে যাবে।
কিন্তু, রবীশ কুমারের পরিচয় নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। এদেশের দরিদ্র, বেকার, বঞ্চিত মানুষের প্রশ্ন তুলে ধরেন এমন কোনো নেতা, সাংবাদিক বা লেখক কখনোই অপ্রাসঙ্গিক হতে পারেন না, যে ক্ষমতা কাঠামোর গণবিরোধী ষড়যন্ত্রের স্তর উন্মোচন করে জনগণের জন্য লেখেন বা কথা বলেন, তিনিই বিজয়ী হবেন। জনগণের হৃদয়ে রাজত্ব করবে।
তথ্যের এত উৎস হয়ে গেছে যে কোনো শক্তি তাকে একচেটিয়া করতে পারে না। যদিও একটি সুশৃঙ্খল সংবাদ চ্যানেল এবং তথ্যের অন্যান্য উত্সের কার্যকারিতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, তবে এটি কম নিশ্চিত নয় যে প্রযুক্তি যারা সত্য কথা বলে, যারা সঠিক তথ্য দেয় এবং যারা জনসাধারণের কথা বলে তাদের জন্য বিকল্প প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। কন্ঠ বন্ধ করা যাবে না।
আদানি শুধু ভারতেই নয়, এশিয়ারও সবচেয়ে ধনী হয়ে উঠেছেন। তিনি কীভাবে হয়েছেন এবং কীভাবে এত দ্রুত হয়ে উঠলেন তা গোপন নয়।
ক্ষমতা এবং কর্পোরেটের অনৈতিক জুগলবন্দি থেকে শীর্ষে পৌঁছানোর তার যাত্রা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে এবং আদানি ইতিহাসের একটি বড় অধ্যায় হয়ে থাকবে যখন এই সময়কালে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে আলোচনা হবে।
তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য
Like
Comment
Right