ইরানের ইতিহাসে, বহু সহস্রাব্দ ধরে, নারীরা সবসময় প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে গত ১৫০ বছরে ইরানের জনগণ একটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং সত্যিকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, প্রতিক্রিয়াশীল ইসলামী গোষ্ঠীগুলো ইরানের জন্য আসলে কী ধরণের সমাজের কল্পনা করে তা প্রকাশ করতে খুব বেশি সময় নেয়নি।এভাবে বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায় আসার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৭৯ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে নারীদের প্রথম বিক্ষোভ হয়। যুগের প্রেক্ষাপটে এটা সত্যিই সাহসী কাজ ছিল।
শুধু ইরান নয়, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই নারী অধিকারের জন্য বিভিন্ন সংগ্রাম চলছে। এমন পরিস্থিতিতে নার্গিসের পাওয়া এই সম্মান তার পাশাপাশি নারী অধিকারের জন্য কাজ করা সমস্ত মানুষের জন্য একটা বড় অর্জন, যা মৌলবাদী এবং পিতৃতান্ত্রিক ধারণার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর সাহস দেয়। মানবতা, অধিকার, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতার দাবি আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে সমস্ত বিপদকে আমন্ত্রণ জানায়।
নার্গিস বর্তমানে কারাগারে আছেন এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই এবং নারীর স্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রচারের কথা বলার জন্য তাকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে।
ইরানের কারাগারে বন্দী নারী অধিকারের জোরালো কণ্ঠস্বর নার্গিস মোহাম্মদি গত কয়েকদিন ধরেই খবরের শিরোনামে রয়েছেন, কারণ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার, যা সম্প্রতি ঘোষণা করেছে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। এটা খুবই হাস্যকর যে, নার্গিসের সংগ্রাম আজ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে এবং তাকে ইরান সরকার কারারুদ্ধ করেছে। নোবেল পুরষ্কার কমিটিও স্বীকার করেছে যে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, নারীস্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য নার্গিসকে বড় মূল্য দিতে হচ্ছে। নোবেল পুরস্কারের ১২২ বছরের ইতিহাসে এই নিয়ে পঞ্চমবার, কারাগারে বা গৃহবন্দী কাউকে শান্তি পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। নার্গিস একজন নারী ও মানবাধিকার কর্মী ছাড়াও ডিফেন্ডার অব হিউম্যান রাইটস সেন্টারের সহ-সভাপতি। ২০০৩ সালে শিরিন এবাদির পর তিনিই ১৯তম নারী যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাচ্ছেন এবং দ্বিতীয় ইরানি নারী যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাচ্ছেন।
১৩ বার গ্রেফতার, ৩১ বছরের জেল এবং ১৫৪ বেত্রাঘাতের সাজা-
হয়তো অনেকেই জানেন, নার্গিস মোহাম্মদীকে জেলে পাঠানোর ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ইরানের নির্দেশে তাকে ১৩ বার গ্রেফতার করা হয়েছে। ৫১ বছর বয়সী নার্গিসকে ৩১ বছরের কারাদণ্ড ও ১৫৪ বেত্রাঘাতের সাজা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন নার্গিস আজ পর্যন্ত তার উদ্দেশ্য থেকে সরে আসেননি। নব্বইয়ের দশক থেকে তিনি নারী অধিকারের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এবং অমানবিক নির্যাতন সত্ত্বেও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। নার্গিস ১৯৭২ সালে ইরানের কুর্দিস্তানের জানজান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন এবং পড়াশোনার সময়ই, মহিলাদের সংগ্রামের প্রতি তার আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি ইরানের সামাজিক সংস্কার নিয়ে অনেক আর্টিকেল লিখেছেন। তার বই ‘হোয়াইট টর্চার: ইন্টারভিউস উইথ ইরানিয়ান উইমেন প্রিজনার্স’ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এবং মানবাধিকার ফোরামে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের জন্য একটি পুরষ্কারও জিতেছে। নার্গিস একজন নারী অধিকার কর্মী এবং সবার জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকারের পক্ষে। তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে নারীর মর্যাদা, সমতা ও স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ লড়াই করে যাচ্ছেন।
ইরানের একনায়কতন্ত্রের জন্য নার্গিসের প্রতি এই সম্মান শ্রদ্ধা একটি শিক্ষা-
নার্গিস পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন এবং পড়াশোনার পর প্রকৌশলী হিসেবেও কাজ করতেন। কিন্তু নার্গিসের মন তার দেশে নারীদের উপর নৃশংসতা দেখে বিদ্রোহের দিকে মোড় নেয়। যার কারণে তাকে বহুবার জেলে যেতে হয়েছে। নার্গিস ২০১১ সালে প্রথম জেলে যান কারাবন্দী কর্মী এবং তাদের পরিবারকে সহায়তা করার জন্য। সেখানকার মৌলবাদী সরকারের মতে, এটা একটা বিদ্রোহের কাজ। ইরানের একনায়কতন্ত্র অব্যাহত রয়েছে, যেখানে মানবাধিকার, বিশেষ করে নারী অধিকার প্রকাশ্যে পদদলিত হচ্ছে। এর একটি উদাহরণ হলো, ইরানে নারীদের বিয়ের বয়স ১৩ বছর, যা মেয়েদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য সঠিক নয়। যাইহোক, কারাগারের দেয়াল নার্গিসের সাহসি পদক্ষেপকে থামাতে পারেনি, দু বছর পরে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে তিনি নারী অধিকারের জন্য তার কাজে আরও গতি এনে ছিলেন, নারী স্বাধীনতার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানেও অংশ নিয়েছিলেন।যার জন্য ২০১৫ সালে তাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার সাজা বাড়ানো হয়। তিনি এখনো কারাগারে আছেন। কিন্তু তাদের সংগ্রামের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সারা বিশ্বে। এমনকি জেল থেকেও ক্ষমতার নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক বন্দীদের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। তিনি সেখানে নারী বন্দীদের উপর হয়রানি এবং যৌন হিংসার ধারাবাহিকভাবে বিরোধিতা করে আসছেন।
ওরা যত বেশি আমাদের গ্রেপ্তার করবে, আমরা তত শক্তিশালী হব-
গত বছর ইরানে নারীদের বোরখা নিয়ে যে ঐতিহাসিক সংগ্রাম হয়েছিল, সেই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন মাহসা আমিনি নামের এক কুর্দি তরুণী, যিনি ইরানের নীতি পুলিশের হেফাজতে নিহত হন।মাহসা তার মাথা ঢেকে রাখেনি, যার কারণে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনায় ইরানে নারী অধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। হাজার হাজার ইরানি ‘নারী-জীবন-স্বাধীনতা’ স্লোগানে সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিল। এরপর নার্গিস মোহাম্মাদি তেহরানের এভিন কারাগার থেকে তার সহকর্মীদের একত্রিত করেন এবং দেশের এই বিক্ষোভে তার সমর্থন জানান। তিনি কোনওরকমে একটা সংবাদপত্রে তার লেখা পাঠিয়েছিলেন। মাহসা আমিনির মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নার্গিস লিখেছেন, ‘তারা আমাদের যত বেশি আটকে রাখবে, আমরা তত শক্তিশালী হব’ অর্থাৎ তারা যত বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করবে, আমরা তত শক্তিশালী হব।
নার্গিস মুহাম্মাদিকে নোবেল শান্তি পুরষ্কারের ঘোষণা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ যা ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মহিলাদের উপর নৃশংসতাকে চিহ্নিত করে এবং এই হুমকিটি গত দশ বছর ধরে ভারতে বিরাজ করছে।
একদিকে রাষ্ট্র শক্তি, দমনের নতুন নতুন উপায় বের করে আন্দোলনের আওয়াজকে দমনের চেষ্টা জারি রেখেছে, অন্যদিকে নার্গিসের মতো মানুষ আছেন যারা এই রাষ্ট্র শক্তির জন্য শুধু চ্যালেঞ্জই নয়, শিক্ষাও বটে।
এটা প্রমাণিত আজ যে লাখ চেষ্টা করেও প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে দমন করা যায় না। আজ, নার্গিস তার স্বামী এবং যমজ সন্তান আলি এবং কিয়ানার কাছ থেকে দূরে, আট বছর ধরে তাদের দেখা হয়নি। ধর্ম ও দেশের নিরাপত্তার নামে এই নৃশংসতা আর কতদিন চলবে?
মিলি