মিলি মুখার্জী
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো দ্বারা সংকলিত তথ্য অনুসারে, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে, অর্থাৎ মাত্র তিন বছরে সারা দেশে ১৩ লাখেরও বেশি মেয়ে ও মহিলা নিখোঁজ হয়েছে। উদ্বেগজনক সত্য হলো যে, নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মেয়ে এবং মহিলাদের সংখ্যা বলছে যে ভারতীয় সমাজ তাদের প্রতি কতটা মারাত্মক। দিল্লির নির্ভয়া কান্ডের পর মহিলাদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইন কড়া করা হয়েছিল, কিন্তু এই ঘটনা সামনে আসার পর এটা কি বলা যায় যে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে ? ভারতে, কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলো মহিলাদের সুরক্ষার বিষয়ে অনেক বড় বড় দাবি করে, কিন্তু গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পার্লামেন্টে দেশে নিখোঁজ মহিলাদের নিয়ে যে তথ্য পেশ করেছে, তাতে প্রশ্ন উঠেছে: দেশে মেয়েরা এবং মহিলারা কি নিরাপদ? মণিপুর, পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান এবং বিহারে নারীদের উতপীড়নের বিষয়ে আলোচনা চিলাকালীনই জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো দ্বারা সংকলিত এই তথ্য সংসদে উপস্থাপন করা হয়। দেশে ১৩.১৩ লাখেরও বেশি মেয়ে ও মহিলা নিখোঁজ হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মহিলা ১০,৬১,৬৪৮ এবং ২,৫১,৪৩০ জন এই বয়সের নীচে। কোথায় গেল এইসব মেয়ে ও নারীরা ? এই প্রশ্ন আজ গোটা সমাজের সামনে। এইসব নারী ও মেয়েরা কি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা গ্যাংয়ের নরকে হারিয়ে গেছে নাকি ধনীদের বাড়ি বা খামারবাড়িতে হারিয়ে গেছে? কেন জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের অপরাধ বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না? বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও, সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা, বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা, সিবিএসই উড়ান যোজনা, ধনলক্ষ্মী যোজনা এবং বিভিন্ন দলের রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থাকা সত্বেও সমস্ত সরকারই এই সব মেয়ে ও মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। সংসদে দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, নিখোঁজ সর্বাধিক সংখ্যক কেস লাডলি লক্ষ্মী স্কিম চালানো বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশে, যেখানে উল্লিখিত তিন বছরের মেয়াদে ১,৬০,১৮০ জন মহিলা এবং ৩৮,২৩৪ জন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে। এর পরেই কন্যাশ্রী প্রকল্প চালানো তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবঙ্গের স্থান। যেখানে ১,৫৬,৯০৫ জন মহিলা এবং ৩৬,৬০৬ জন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে ৷ তারপরে মহারাষ্ট্র যারা মাজি কন্যা ভাগ্যশ্রী প্রকল্প চালু করেছে, সেখানে এই সময়ের মধ্যে ১,৭৮,৪০০ জন মহিলা এবং ১৩,০৩৩ জন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে ৷ এরপরে উড়িষ্যায় ৭০,২২২ জন মহিলা এবং ১৬,৬৪৯ জন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে এবং ছত্তিশগড়ে ৪৯,১১৬ জন মহিলা এবং ১০,১৮৭ জন মেয়ে এই তিন বছরের সময়কালে নিখোঁজ হয়েছে ৷ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে দিল্লি তালিকার শীর্ষে রয়েছে, যেখানে ৬১,০৫৪ মহিলা এবং ২২,৯১৯ জন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে, যেখানে জম্মু কাশ্মীরে এই সময়কালে পরিসংখ্যান যথাক্রমে ৮,৬১৭ এবং ১,১৪৮ । মনে রাখবেন এটি নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের একটি মাত্র দিক। এর অন্যান্য দিকগুলোতে ধর্ষণ, যৌতুকের জন্য মৃত্যু, পারিবারিক হয়রানি, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, গর্ভপাত, অ্যাসিড হামলার মতো গুরুতর অপরাধও আছে। ভারতে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু মূলগুলো হল আদর্শগত ও রাজনৈতিক। আদর্শগতভাবে বলতে গেলে, পুরো কর্পোরেট পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটি মূলত একটি পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার উপর ভিত্তি করে, যেখানে ধনী ও ক্ষমতাশালী পরিবারের প্রায় ১০ শতাংশ মহিলা ছাড়া সমস্ত মহিলাকে পুরুষদের তুলনায় গৌণ মর্যাদায় রাখা হয়, তাদের পুরুষের সমান অধিকার নেই। শহুরে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণী ছাড়াও গ্রামীণ কৃষক পরিবারের নারীরাও এর অন্তর্ভুক্ত। যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত লিঙ্গ সমতার পরিবেশ সৃষ্টির পরিবর্তে কর্পোরেট পুঁজিবাদী ব্যবস্থা খেলাধুলা, ফিল্ম শো, বিউটি পেজেন্ট ইত্যাদির মতো সব ধরনের কর্মকাণ্ডের বাণিজ্যিকীকরণ করেছে। দ্বিতীয় প্রধান কারণ এই যে, এই ব্যবস্থা পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলগুলোতে অনেক নেতা নিজেরাই নারীদের হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত, তাই তারা নারী সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধে আন্তরিক নয়। বিধায়কদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা সংক্রান্ত অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (ADR) এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলগুলির এই অবস্থান ধরা পড়েছে। এই রিপোর্ট অনুসারে, দেশের বিধানসভার প্রায় ৪৪ শতাংশ প্রতিনিধি, অর্থাৎ প্রায় ১,৭৬০ জন বিধায়ক নিজেদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ঘোষণা করেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে, ১১৪ জন বিধায়ক রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংক্রান্ত মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জন বিধায়ক বিশেষভাবে নিজেদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা (আইপিসির ৩৭৬ ধারা) ঘোষণা করেছেন। যতদিন পর্যন্ত সমাজ নারীদের প্রতি সংবেদনশীল না হবে, তাদের সুরক্ষা ও যৌন হয়রানির থেকে বাঁচাতে যতই কঠোর আইন করা হোক না কেন, তা কার্যকর হবে না।