কালাগ্নি রুদ্র
আমরা যদি মানব উন্নয়নের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে জীববৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এর কারণ হল মানুষ সাধারণত তাদের বসবাসের জন্য এমন জায়গা বেছে নিয়েছে যেখানে তাদের জীবনযাত্রা সহজ হবে, যেখানে খাবার এবং জল সহজেই পাওয়া যায়। উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্ষেত্রেও তাই। এইভাবে স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে মানুষের জনসংখ্যা এবং জীববৈচিত্র্যের মধ্যে মিল রয়েছে। সভ্যতার ইতিহাসবিদরা এটিকে জনসংখ্যার গিঁট ( population knots ) নাম দিয়েছে।
গবেষকরা জীববৈচিত্র্য এবং ভাষাগত বৈচিত্র্যের মধ্যে গভীর সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন। বিশ্বে জীববৈচিত্র্য যেমন কমছে, তেমনি ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের প্রাণী ও উদ্ভিদের বৃহৎ আকারে বিলুপ্তির পাশাপাশি ভাষাও আশঙ্কাজনক হারে মারা যাচ্ছে।
জীববিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে প্রজাতির বিলুপ্তির বার্ষিক হার পূর্বের ধারণার চেয়ে ১০০০ গুণ বা তার বেশি হতে পারে। অন্যদিকে, কিছু ভাষাবিদ অনুমান করছেন যে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বের ৫০-৯০ শতাংশ ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
এটা কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। গবেষণাতে দেখা যায় যে বিশ্বের সবচেয়ে জীববৈচিত্র্য-সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো – নিউ গিনির বনাঞ্চল থেকে পশ্চিম আফ্রিকার গিনির জঙ্গল পর্যন্ত – আশ্চর্যজনকভাবে বেশিরভাগই এমন ক্ষেত্র যেখানে অত্যধিক ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও পাওয়া যায়। এই দুই প্রক্রিয়ায় কোন না কোনভাবে একসাথে চলে।
আসলে বিশ্বের ৬০০০ টিরও বেশি জীবিত ভাষার মধ্যে প্রায় ৫০০০ টি ভাষা অনেক বেশি জীববৈচিত্র্যের অঞ্চলে রয়েছে। খুব কম লোকই আছে যারা এসব ভাষায় বেশি কথা বলে। এবং একটি ভাষায় কথা বলার লোক যত কম, তার বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি।
জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে অতিরিক্ত সক্রিয় অঞ্চলে ৩,২০২ টি ভাষার মধ্যে, ১,৫৫৩ টি ভাষায় ১০,০০০ বা তার চেয়েও কম মানুষ কথা বলে। প্রায় ৫৪৪ টি ভাষা এমন যেগুলোতে কথা বলার মানুষ ১,০০০ বা তার চেয়েও কম ।
অত্যন্ত জীববৈচিত্র্যের বন্য অঞ্চলের ১,৬২২টি ভাষার মধ্যে ১,২৫১টি ভাষা ১০,০০০ বা তার কম লোক বলে এবং ৬৭৫টি ভাষায় কথা বলা মানুষ ১,০০০ বা তার চেয়েও কম ।
আসলে ভাষার মৃত্যু আমাদের সকলের জন্য উদ্বেগের বিষয়। প্রতিটি ভাষারই পৃথিবীকে দেখার এবং বোঝার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বর্তমানে ভাষার জন্য বড় বিপদ হলো প্রযুক্তি। কৃত্রিম মেমরি (মানুষের তৈরি মেমরি চিপ) “ভার্চুয়াল জগতে জীবনের” সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। এই নতুন পৃথিবীতে সময় এবং স্থানের কোন সীমা নেই। এই নতুন বিশ্বে যোগাযোগ হচ্ছে সংখ্যার মাধ্যমে। আমাদের মনে রাখতে হবে সংখ্যাগুলো কোনো উপাদান দিয়ে তৈরি নয়। তারা স্থান দখল করে না বা মাধ্যাকর্ষণের নিয়মে বাঁধা নয়। এর ক্ষতি না করে সহজেই পৃথিবীর পরিবেশের বাইরে পাঠানো যেতে পারে। এভাবে মানুষ এমন ভাষার গঠন করছে যেগুলো ধ্বনিগত নয়। তারা পৃথিবীর বাইরে পৌঁছাতে পারে এবং আলোর গতিতে ভ্রমণ করতে পারে। এই ভাষাগুলোর শব্দের চেয়ে ছবির দিকে অভিমুখ। এইভাবে মানুষ ডিজিটাল ভাষার উপর ভিত্তি করে বিস্তৃত চিত্রের আকার দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই প্রক্রিয়ায় মানুষ সেই ধ্বনি আধারিত ভাষাগুলোকে ধ্বংস করছে যা গত ৭০,০০০ বছর ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। এই পরিবর্তনের ফলে হারিয়ে যাবে মানুষের চিরায়ত ভাষার স্মৃতি। ঐতিহাসিক ভাষাগুলো হারিয়ে ফেললে বিরাট ক্ষতি হবে। মানুষের ভাষা থেকে ছবি-ভিত্তিক ভাষায় স্থানান্তর করা মানুষের জন্য খুব বেদনাদায়ক হবে।
ভাষার সময় কাঠামোর ক্রমাগত অবনতি প্রমাণ করে যে এর ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে।