শুধু ব্রিটিশরাই নয়, অন্যান্য দেশগুলোও ভারতের ওপর লোভের দৃষ্টি রেখেছে। পর্তুগাল তাদের মধ্যে একজন ছিল, যারা এক সময় ভারতে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে যেমন বিদ্রোহ হয়েছিল, তেমনি পর্তুগিজদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন রানী আব্বাক্কা চৌতা, যিনি 16 শতকে পর্তুগিজদের সাথে লড়াই করেছিলেন।
বীরাঙ্গনা রানী আব্বাক্কা কে ছিলেন?
রানী আব্বাক্কা ছিলেন চৌটা রাজবংশের রানী, যিনি টুলু নাড়ু শাসন করতেন। টুলু নাড়ু বর্তমান কর্ণাটকের দক্ষিণ কন্নড় জেলা, উদুপির কিছু এলাকা এবং কেরালার কাসারাগোদ জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছিল।
চৌটা রাজবংশ মাতৃতন্ত্র অনুসরণ করত। এমন পরিস্থিতিতে রাজা তৃতীয় তিরুমালার শাসন তার ভাইঝি আব্বাক্কাকে দেওয়া হয়। উল্লাল ছিল তাদের রাজধানী।
রানী আব্বাক্কা প্রথম থেকেই ছিলেন ক্ষিপ্র মেজাজের। এছাড়াও, কূটনীতি এবং শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তার ভাল ধারণা ছিল। এই কারণেই তিনি পর্তুগিজদের সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষার সাথে পরিচিত ছিলেন। রাণী ম্যাঙ্গালোরের রাজা লক্ষ্মাপ্পা বঙ্গরাজের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু তারপরও তিনি শাসন কার্যের জন্য উল্লালেই থেকে যান।
পর্তুগিজরা রাজা বঙ্গরাজকে তার রাজ্য বিস্তারে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। রানী আব্বাক্কা বিষয়টি জানতে পেরে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে দেন। বঙ্গরাজ প্রতিশোধ নিতে পর্তুগিজদের সাথে যোগ দেন এবং রানীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন।
উল্লাল ছিল একটি সমৃদ্ধ সমুদ্রতীরবর্তী শহর। এমন পরিস্থিতিতে পর্তুগিজদের নজর আগে থেকেই ছিল তার দিকে। পর্তুগিজ নৌবাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ায় তারা আরব সাগরে যাওয়া রাণীর জাহাজ থেকে যথেচ্ছ কর দাবি করতে থাকে।
কিন্তু রানী আব্বাক্কা তাদের অবৈধ দাবির কাছে মাথা নত করেননি এবং পর্তুগিজদের একটি কথাও মানতে অস্বীকার করেন। রানি আব্বাক্কার জাহাজ আরবে মালামাল নিয়ে যেতে থাকে, পথেই পর্তুগিজরা আক্রমণ করে।
রানীর মনোভাব দেখে পর্তুগিজরা সিদ্ধান্ত নিল উল্লালকে দখল করতে হবে। এমতাবস্থায় শুরু হয় লাগাতার হামলা কিন্তু পর্তুগিজরা জানত না যে রানী আব্বাক্কা তাদের সামনে এত বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
চৌতা রাজবংশ জৈন ধর্ম অনুসরণ করত। কিন্তু রাণীর সৈন্যবাহিনীতে বিপুল সংখ্যক হিন্দু ও মুসলমান ছিল। পর্তুগিজ এবং রানী আব্বাক্কার মধ্যে প্রথম যুদ্ধ হয় 1555 সালে।
পর্তুগালের অ্যাডমিরাল ডন আলভারো ডি সিলভেরা উল্লালকে জয় করতে এসেছিলেন, কিন্তু খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল। যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর পর্তুগিজরা পিছু হটে।
যাইহোক, 1558 সালে তারা আবার দ্বিগুণ সৈন্য নিয়ে উল্লাল আক্রমণ করতে আসে। এবার উল্লালের কিছুটা ক্ষতি করতে সফল হয়। কিন্তু পুরোপুরি না। রানী আব্বাক্কা তার দক্ষ যুদ্ধ কৌশলে কোঝিকোড়ের জামোরিন এবং আরব মুররার সাহাজ্যে আবার পর্তুগিজদের পরাজিত করে।
কিন্তু হামলা থামেনি। 1567 সালে, আবারও পর্তুগিজ সেনারা উল্লালকে দখল করতে পৌঁছায় এবং খালি হাতে ফিরে আসে।সেই বছরেই, গোয়ার পর্তুগিজ ভাইসরয় অ্যান্টনি ডি’নরোনহা উল্লালকে জয় করার জন্য জেনারেল জোয়াও পিক্সোটোকে পাঠান।
পেইক্সোতো প্রাসাদ দখলে সফল হন। কিন্তু, রানী আব্বাক্কা পর্তুগিজদের হাতে না পড়ে একটি মসজিদে আশ্রয় নেন।
এরপর রাতের আঁধারে মাত্র 200 সৈন্য নিয়ে পর্তুগিজদের উপর আক্রমণ করে জেনারেল ও তার 70 জন সৈন্যকে হত্যা করে। আক্রমণটি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে বাকি পর্তুগিজ সৈন্যরা প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যায়। এইসব ঘটনা যারা জানত না সেইসব পর্তুগিজ সৈন্যরা উল্লালে তাদের বিজয় উতসব পালন করছিল।এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, রানী আব্বাক্কার 500 সমর্থক পর্তুগিজদের উপর আক্রমণ করে এবং অ্যাডমিরাল মাসকারেনহাসকে হত্যা করে।
ফলস্বরূপ, 1568 সালে পর্তুগিজদের ম্যাগালোর দুর্গ ত্যাগ করতে হয়েছিল। যাইহোক, 1569 সালে, পর্তুগিজরা কুন্দপুরের পাশাপাশি ম্যাঙ্গালোর দুর্গ পুনরুদ্ধার করে।
রানী পর্তুগিজদের কাছে পরাজয় মেনে নেবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। পর্তুগিজরাও রানীকে ছাড়তে চায়নি। এমতাবস্থায়, 1581 সালে, তিনি 3000 পর্তুগিজ সৈন্য সহ অ্যান্টনি ডি’নরোনহাকে উল্লালকে আক্রমণ করার জন্য পাঠান। এ সময় রানি আব্বাক্কা মন্দির থেকে ফিরছিলেন এবং অতর্কিত হামলায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
রানীর প্রাক্তন স্বামী রানির যুদ্ধনীতি, গোপন পথ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পর্তুগিজদের দিয়ে দেন। এর সুযোগ নিয়ে পর্তুগিজরা রানীকে বন্দী করে। রানী আব্বাক্কা জেলে থেকেও পর্তুগিজদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে শহীদ হন।
ইতিহাসের বই হয়তো রানি আব্বাক্কাকে ভুলে গেছে, কিন্তু তিনি এখনও দক্ষিণ কন্নড় অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিতে বেঁচে আছেন। যক্ষগানের মতো নাট্যশিল্পে রাণী আব্বাক্কার গল্প সেখানে নতুন প্রজন্মের সামনে রাখা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, তার গল্প ধীরে ধীরে জনসাধারণের কাছে পৌঁছেছে।
2003 সালে ভারতীয় ডাক বিভাগ রানী আব্বাক্কাকে উৎসর্গ করা একটি বিশেষ ডাকটিকিট জারি করে।2009 সালে, ভারতীয় কোস্ট গার্ড তার নামে ভারতীয় সীমান্ত পর্যবেক্ষণের জন্য ICGS রানী আব্বাক্কা নামে একটি জাহাজ মোতায়েন করে।
দক্ষিণ কন্নড়ের বান্টওয়াল তালুকের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক তুকারাম পূজারিও উল্লালের রাণী আব্বাক্কা চৌতার স্মরণে একটি জাদুঘর তৈরি করেছেন।
মিলি মুখার্জী