ভূমিকা

আগামী ২০২১ সালে ভারতবর্ষে জনগণনার কাজ শুরু হবে । অনুমাণ করা যায় ভারতবর্ষে জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৩৫ কোটির আশপাশ । ইতোমধ্যে ভারতবর্ষে সরকার নাগরিক আইন কঠোরভাবে লাগু করতে চাইছে । কিন্তু আপামর ভারতীয় সাধারণ জনগনের আপত্তি সেখানে সাধারণত নেই । কিন্তু এই নাগরিক আইনের নামে ভারতবর্ষে ধর্মীয় মেরুকরণকে সুষ্পষ্ট রূপ দেওয়ার একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে । সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে ২০১৫ সাল নাগাদ NRC লাগু করা এবং নাগরিক সংশোধনী বিল ২০১৬ বা CAB সংসদে পেশ করার প্রস্তুতি নেয় । আমাদের দেশে বহুবার বিভিন্ন নামে নাগরিক আইন সংক্রান্ত বিল আনা হয়েছে সংসদে ।বিভিন্ন নাগরিক বিধি ও আইন
আসামে NRC থেকে ১৯ লক্ষ মানুষ বে-নাগরিক ঘোষিত হবার পর স্বাধীনতা পরবর্তী যুগের নাগরিককরণ সংক্রান্ত কয়েকটি বিল ,আইন ও ব্যবস্থার কথা সামনে ভেসে আসছে । সে সম্পর্কে সমস্ত কান্ডকারখানা ভারতবাসী তথা বাঙালীর জেনে রাখা অত্যন্ত দরকার । যেমন ১) জাতীয় নাগরিক আইন (Indian Citizenship Act 1955 ) ২)আসাম একর্ড , ৩) ১৯৮৭ সালের NRC , ৪) উদ্বাস্ত সংক্রান্ত নাগরিক আইন ২০০৩ , ৫)সিটিজেন্স এমেন্ডমেন্ট বিল CAB 2016 ( যা শীতকালীন অধিবেশনে পাশ হতে চলেছে ) , ৬) ১৯ শে জুলাই ২০১৯ স্বরাষ্ট্র দপ্তর কতৃক অধ্যাদেশ National Population Register ( NPR) যেসব তথ্য সরকারি কর্মীরা আপনার বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করবে ১লা এপ্রিল থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২০ , ৭) এর ভিত্তিতে সারা দেশে নাকি বানানো হবে NRIC ( National Register of Indian Citizen ) । ৮) এরপর হবে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে Cencuss (জনগণনা) । এত আইনের জাল ছড়ানো হয়েছে নাগরিক ধরে ধরে জালে পোরার জন্যে আর কিছু শতাংশ মানুষকে নির্যাতনের যাঁতাকলে ফেলে দেশময় এক বিভ্রান্তি গড়ে তোলার প্রয়োজনে ।
১৯৪৭ এর পর দেশে উদ্বাস্তু
১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত মূলত যেসব দেশ থেকে ভারতে মানুষ প্রবেশ করেছেন -১/ বাংলাদেশ থেকে মূলত হিন্দু বাঙালী ও মাড়োয়াড়ি, আর তুলনায় কম মুসলিম বাঙালী ।২/ পাকিস্তান থেকে শিখ, হিন্দু পাঞ্জাবী, জাঠ, সিন্ধ্রি, রাজপুত, গুজরাটি, মারোয়াড়ি এবং আহমোদিয়া মুসলিম।৩/ নেপাল থেকে গোর্খা, যদিও ১৯৫০ সালের ভারত-নেপাল চুক্তির বলে নেপালের নাগরিকরা এমনিতেই ভারতে বাস ও উপার্জন করতে পারেন।৪/শ্রীলঙ্কার জাফনা অঞ্চল থেকে তামিল অনুপ্রবেশও হয়েছিল। সাম্প্রতিককালে আফগানিস্তান থেকে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ অনুপ্রবেশ করেছেন।৫) আর অতি সম্প্রতি বার্মা থেকে এসেছেন কিছু রোহিঙ্গা মুসলিম।
আসামের NRC এর ইতিহাস
সব ইতিহাসের একটা পূর্ব ইতিহাস থাকে। এন আর সির আগেও আর একটা এনআরসি ছিল। ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতে প্রথম জনগণনা করা হয়। তখন সমস্ত ভারতীয় নাগরিকের হিসেব নেওয়া হয়েছিল, এন আর সি’তে সে তথ্য ঢোকানো হয়েছিল।এই এন আর সি নিয়ে এখন আসাম তথা ভারতের রাজনীতি সরগরম। ৩০ শে জুলাই ২০১৮, আসামে সেই নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়েছিলো যাতে আসামের ৩০ লক্ষ বাঙালী তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব হারিয়েছিল। বিদেশী চিহ্নিতকরণ ও বিতাড়ন আসামের রাজনীতির এক কার্যকলাপ দীর্ঘ সময় যাবৎ।এনআরসি প্রক্রিয়ার আগে ছিল “ইললিগ্যাল মাইনরিটি (ডিটারমিনেশন বাই ট্রাইবুন্যাল) আইন”, যা পার্লামেন্টে পাশ হয় ১৯৮৩ সালে, ইন্দিরা গান্ধীর সময়। ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই আইনটিকে অবৈধ হিসাবে বাতিল করে। অর্থাৎ দীর্ঘ ২২ বছর ধরে আইনটি বলবৎ ছিল বাংলাদেশী চিহ্নিতকরণ ও আসাম থেকে তাদের বহিষ্কারের জন্য। নাগরিকত্ব, এন আর সি ইস্যুকে কেন্দ্র করে অসমীয়া-বাঙালিদের মধ্যে সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চাইছে খোদ কেন্দ্রীয় সরকার । মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিন বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে মন্ত্রী নেতারা। হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিভাজন সৃষ্টি করে ভোট মেরুকরণের রাজনীতিতে সাফল্য পেয়েছে দেশের শাসকদল ,আর সেই বিভাজনকেই হাতিয়ার করে সরকার গঠনে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা ধরে রাখতে চায় বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদল ।দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলেও সংবিধানে এই নীতিকে মান্যতা দেওয়া হয়নি কোনদিন ।সংবিধান গ্রহণের দিন কারা ভারতের নাগরিক বলে স্বীকৃত হলেন, সেটাও স্পষ্ট করে দেওয়া হল। এরপরেই মূলত আসামের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈয়ের চাপে সেই বছরই ১ মার্চ পাশ হল The Immigrants (Expulsion from Assam) Act । সেই আইন অনুযায়ী, ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০-তারিখের পর আসামে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বহিষ্কারের ক্ষমতা দেওয়া হল কেন্দ্রীয় সরকারকে। কিন্তু ১৯৫৫ সালে Indian Citizenship Act সংসদে পাশ হয় । এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালে The immigrants ( Expulsion from Assam ) Act প্রত্যাহৃত হয় এবং ফলশ্রুতিতে আসামে NRC তার প্রাসঙ্গিকতা হারায় । এরপর থেকে আসামে একের পর এক গণহত্যা, বাঙালীখেদা, বিহারীখেদা ঘটতে থাকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ।
মণিপুরে NRC কি প্রহসন নয় ?
ছোট্ট একটা রাজ্য মণিপুর। সব মিলিয়ে বোধহয় ১৯ লক্ষ লোকের বাস। নয় লক্ষ অ-মণিপুরী। তাদের হাত থেকে মণিপুরী কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে মণিপুর বিধানসভায় ( যেখানে বিজেপির সরকার) “মণিপুর পিপলস প্রোটেকশান বিল ২০১৮” পাশ হয় যে বিলে বলা আছে মণিপুরে মৈতেই মণিপুরী, পঙ্গাল মুসলমান, সংবিধানে নথিভুক্ত জনজাতি এবং ১৯৫১ সালের আগে মণিপুরে বসবাসকারী সকল নাগরিক মণিপুরী হিসাবে বিবেচিত হবে। বাকি অ-মণিপুরীদের অনাগরিক শ্রেণিতে রাখা হয়েছে এবং তাদের এক মাসের মধ্যে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করাতে হবে। তবে তারা থাকার জন্য একটি পাস পাবে যা ছয় মাসের জন্য বহাল থাকবে। যাদের ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্স আছে, তারা পাঁচ বছর পর্যন্ত একটি পাসের সময়সীমা বাড়াতে পারেন, যা প্রতিবছর নবীকরণ করা হবে। যে কোনও বহিরাগতকে মণিপুরে ঢুকতে হলে পাসের প্রয়োজন হবে। প্রশ্ন হলো ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরা হলো, অথচ প্রদেশটির জন্মই হয়েছে ১৯৭২ সালে। সেক্ষেত্রে প্রামাণ্য নথি কী হবে?
ডিটেনশান ক্যাম্প যা পশুখামার
কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহ মন্ত্রকের বিবৃতি বলছে ২০০১ সালে আসামে নাকি ৫০ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশি বসবাস করতেন (সারা দেশে ১ কোটি ২০ লক্ষ)। গৃহ মন্ত্রক কোত্থেকে এই তথ্য জোগাড় করেছে জানা যায় নি। নাগরিক পঞ্জী থেকে কারো নাম বাদ যাওয়ার অর্থ, তাদের অদূর ভবিষ্যতে বিদেশী বলে চিহ্নিত করা হবে।ভারতীয় নাগরিকত্ব খুইয়ে তারা অচিরেই পরিণত হবেন রাষ্ট্রবিহীন মানুষে।ক্ষমতায় এসে সারাদেশে বহু কোটি ব্যয়ে প্রায় ১০০টি ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করছে কেন্দ্রীয় সরকার । পশ্চিমবংগেও রাজারহাট ও বনগাঁয় ডিটেনশান ক্যাম্প বানোনোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে । আসামে সহস্রাধিক মানুষ ডিটেনশন ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছেন। আসামে এন আর সি-তে নাম না ওঠা মানুষদের যখন তখন বিদেশী নোটিস ধরিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। সেখানে কুকুর বেড়ালের মতো মানুষ মারা যাচ্ছে নিত্যদিন । অসংখ্য নারী প্রায় প্রতিদিন ধর্ষিতা হচ্ছে সেই ক্যাম্পে । এ যেন হিটলারের ৬০ লক্ষ ইহুদীর জন্যে কনসেনট্রেসন ক্যাম্প ।
অন্যান্য জেলের কয়েদীদের অন্তত হাঁটাহাঁটি করার, বা খোলা আকাশের নীচে সময় কাটানোর সুযোগ থাকে। কিন্তু বিদেশী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে যাদের, তাদের সেই সুযোগও নেই। দিনের বেলাতেও তাদের ব্যারাকের মধ্যেই কাটাতে হয়। কারণ অন্য কয়েদী, অর্থাৎ ভারতীয় নাগরিকদের সঙ্গে মেলামেশা করার অধিকার দেওয়া হয় না তাদের।পুরুষ, নারী আর ছয় বছরের বেশী বয়সী শিশুদের পরিবারের থেকে আলাদা করে রাখা হয়।
এইসব বন্দীশিবিরগুলোতে মানবাধিকার কর্মীদের যাওয়া নিষেধ। শিবিরবন্দি মানুষকে নূন্যতম আইনি সহায়তা দেওয়া হয় না। অনেক মানুষই বিদেশী ট্রাইবুনালে(Foreigners Tribunal ) আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পান নি। ফরেনারস ট্রাইবুনাল বা আদালত যেখানে শুনানি চলবে তার পরিকাঠামোই নেই পর্যাপ্ত । কতদিন দেশের এই ডিটেনশন ক্যাম্পে মানুষ থাকবে তা কোথাও বলা নেই । হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নাগরিক রেজিষ্টার তৈরী করার নামে নরহত্যার যজ্ঞ আয়োজন করা সরকার মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে রাখতে চাইছে , যাতে অভুক্ত কর্মহীন মানুষগুলো বেকারত্বের বিরুদ্ধে , বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে , অর্থনৈতিক সর্বাত্মক মন্দার বিরুদ্ধে চর্চা না করতে পারে , বিক্ষোভে ফেটে না পরতে পারে । এছাড়াও এদেশ থেকে যদি কমপক্ষে ২ কোটি বে-নাগরিক মানুষকে যদি লেবার হিসাবে এক্সপোর্ট করা যায় বিদেশে তাহলে দেশের সরকারি খাতে বিরাট অঙ্কের ট্যক্স বাবদ আমদানিও বেড়ে যাবে ।
আসাম গঠনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
NRC নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সংক্ষিপ্তভাবেও আসামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানা অত্যন্ত জরুরী । মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মান সিংহ আসাম অধিকার করেন এবং অ-রাজস্ব আদায়কারী এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেন । তারপর ব্রহ্মপুত্রের উপত্যকা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে । ১৮২৬ সালে অহম রাজা ও আরাকান রাজাদের হাত থেকে আসাম ব্রিটিশ শাসনে আসে । পরবর্তী কালে বাংলাভাষী শ্রীহট্ট জেলাকে আসামের সাথে জুড়ে দেওয়া হয় । আরও পরে গোয়ালপাড়া ও ময়মনসিংহ জেলা থেকে অংশ কেটে নিয়ে আসামের সাথে জুড়ে দেওয়া হয় । চা-বাগানের কাজের জন্যে বিহার ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ ছত্রিশগড় থেকে আদিবাসি শ্রমিক আনা হয় । চা-বাগান পত্তন হওয়ার পর শিক্ষিত বাঙালিদের নিয়ে যাওয়া হয় কেরানির চাকরি দিয়ে । এইভাবেই আসাম গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় । তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় আসামী জাতির ডেমোগ্রাফিক ক্রাইসিস ।
NPR থেকে NRIC সরকারের এক গভীর ষড়যন্ত্রএবছরে ১৯ শে জুলাই ঘোষিত NPR অনুযায়ী NRIC কার্যকর করা শুরু হবে । CAB Bill টা সংসদে পাশ করে মুসলিম অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিতকরণের নামে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কাজ শুরু হবে ।
CAB 2016 (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৬ )বিলটি শীতকালীন অধিবেশনে পাশ হতে চলেছে, যাতে বলা আছে ভারতে যারা উদ্বাস্তু যেমন পার্শি , জৈন, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, হিন্দু এরা নাগরিকত্ব পাবে অথচ আফগানিস্থান, পাকিস্থান, বাংলাদেশ থেকে যে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা এসেছে তারাই অনুপ্রবেশকারী হবে । তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না । অটল বিহারী বাজপেয়ী ২০০৩ সালে যে কুখ্যাত উদ্বাস্তু আইন তৈরী করেছিলেন সেই আইনের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল National Population Register (NPR) আর National Register of Indian Citizen ( NRIC) এর মতো দু’খানি বিষবৃক্ষ । NPR হচ্ছে প্রাথমিক ধাপ , চূড়ান্ত রেজিষ্টার হবে NRIC । সরকার ২০০৩ এর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বলে ২০২০ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই NPR করতে চায় । আর সেটাই হবে দেশজোড়া NRIC । এর পূর্ণমাত্রায় সুযোগ নিতে চলেছে শাসকদল CAB নামে বিলের মাধ্যমে মুসলিম অনুপ্রবেশকারী বিতাড়নের কর্মসূচীর মাধ্যমে । সংসদে শীতকালীন অধিবেশনে CAB যদি সরকার পাস করিয়ে নিতে পারে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে তাহলে দেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতি লাগু করে দীর্ঘমেয়াদী সরকারে যাওয়ার রাস্তা পাকা করে রাখবে । আর ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরকে ভিত্তিবর্ষ ধরে মুসসলমান সম্প্রদায় বাদে সকল ধর্মের বিদেশী চিহ্নিত হওয়া মানুষকে নাগরিক তালিকায় ঢুকিয়ে নেওয়া হবে । এভাবেই দেশের ১৪ শতাংশ মুসলমানের ধর্মকে শত্রুর ধর্ম হিসাবে চিহ্নিত করে প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দু জনগনকে খুশি করা যাবে , যাতে করে সংসদীয় ভোটে জেতার রাস্তাটা বরাবরের জন্যে পাকা করে রাখা যায় ।
আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু নীতি ও প্রকৃতি
কিন্তু যাঁরা বিদেশি বলে চিহ্নিত হবেন, নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবেন না তাদেরকে দেশ থেকে তাড়ানো যাবে না আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু আইনের নিয়মে । বাংলাদেশ উদ্বাস্তু ফিরিয়ে নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছে ।
রাষ্ট্রসংঘের উদ্বাস্তু বিভাগের শীর্ষ অধিকর্তা ফিলিপো গ্রান্ডি রবিবার ভারতের এনআরসিতে ১৯ লক্ষ মানুষের বাদ পড়া নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করেছেন। জেনিভা থেকেই একটি বিবৃতি জারি করেছেন তিনি। তাতে বলা হয়েছে, “যে কোনও প্রক্রিয়া, যাতে অনেক মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে যেতে পারে সেই প্রক্রিয়াই, রাষ্ট্রসংঘের বিশ্বকে উদ্বাস্তশূন্য করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করবে।” গ্র্যান্ডি বলছেন, ভারত সরকারের উচিত এটা নিশ্চিত করা যে কোনও নাগরিকই রাষ্ট্রহীন না হয়ে যায়। সেই সঙ্গে তাঁর আরও দাবি, “প্রত্যেক নাগরিকের তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তাদের উপযুক্ত আইনি পরিষেবা দিতে হবে। সরকারকে আইনি সহায়তা করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে, এঁরা সর্বোচ্চ শ্রেণির পরিষেবা পাচ্ছে।” আসলে, গোটা বিশ্বেই উদ্বাস্তু সমস্যা মেটাতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে রাষ্ট্রসংঘ।
সম্প্রতি মায়ানমারের রোহিঙ্গা বিতড়নের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন করে উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তাই রাষ্ট্রসংঘের উদ্বাস্তু পরিষদ নিশ্চিত করতে চাইছে, যারা ভারতের এনআরসি থেকে বাদ পড়ছেন, তাঁরা যেন রাষ্ট্র্ববিহীন না হয়ে যান। কারণ, বাংলাদেশ আগেই জানিয়ে দিয়েছে ভারতে এনআরসি থেকে বাদ পড়া কেউ বাংলাদেশি নয়। তাই, তাদের পুনর্বাসনের কোনও দায়ও হাসিনার সরকারের নেই। সেক্ষেত্রে, যে বা যাঁরা এনআরসির তালিকা থেকে বাদ পড়বে, তাঁরা প্রত্যেকেই উদ্বাস্তুর তকমা পাবে।
আবার যদি ফরেনার্স ট্রাইবুনালে কেউ যদি আবেদন করেন তাহলে সে মামলা কতদিন চলবে কেউ জানেন না । ততদিন কি তাহলে ডিটেনশন ক্যাম্প নামক পশুখামারে মানুষদের কাটাতে হবে ? বিষয়টি পরিষ্কার নয়। সেক্ষেত্রে যদি কেউ বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে এরার বাংলায় পালিয়ে আসেন তাঁকে প্রমাণ করতে হবে তিনি সেই সময় বাংলাদেশের থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন । প্রমাণপত্র হাজির করতে না পারলে তাঁকেও বছরের পর বছর ওই পশুখামারে কাটাতে হবে । মহামান্য সরকার বাহাদুর জনগনের ট্যাক্সের পয়সায় পশুখামারগুলোর খরচা চালাবেন ।
আপনি কি জানেন এই মুহূর্তে পৃথিবীতে বে-নাগরিক মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৮০ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে।
অনেকেই মনে করেন রাষ্ট্র থাকবে অথচ দেশে নাগরিক আইন থাকবে না এটা হয় না । দেশ সুষ্ঠভাবে চালাতে গেলে প্রত্যেক রাষ্ট্রেই নাগরিক আইন দরকার । কিন্তু সারা পৃথিবীতেই দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রের কারণেই আজ মানুষ বে-নাগরিক হয়ে চলেছে দিনে দিনে । তাও এই শরণার্থীদের ৮৫ শতাংশ মানুষই বাস করে উন্নয়নশীল দেশে । সিরিয়া, ইরাক,থেকে আসা ৩৫ লক্ষ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে তুরস্কে । রাশিয়া-আমেরিকার কারণে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্থানের ১৪ লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে পাকিস্থানে । উগান্ডায় ১৪ লাখ শরনার্থীর চাপ । লেবাননে প্রতি ৬ জনে ১ জন শরণার্থী । এই চাপ নিয়েছে ইরাণ । ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো শরণার্থীর চাপ নিয়েই চলেছে ।
রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তু, উদ্বাস্তু পৃথিবীর সকল আদিবাসি প্রজন্ম।একসময় আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলে উদ্বাস্তু হয়েছে আফগানিস্থান, সিরিয়া,লেবানন,ইয়েমেনের মানুষজন।
২০১৬ সালে খোদ আমেরিকায় গৃহহীনের সংখ্যা ছিল ৫ লক্ষ ৬৪ হাজার। গৃহহীনদের মধ্যে সাবেক যোদ্ধাই ৪৭ হাজার। মোট গৃহহীনের ৪৫% কৃষ্ণাঙ্গ, ৪৯% শ্বেতাঙ্গ, ৯% নারী। কেবল গৃহহীন শিশুদের সংখ্যাই ১ লক্ষ ১২ হাজার। নিউইয়র্কে গৃহহীন ৯২ হাজার, ফ্লোরিডায় ৩১ হাজার, টেক্সাসে ২৫ হাজার। ক্যালিফোর্নিয়াতে ১ লাখ ৩০ হাজার। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মেক্সিকোয় প্রাচীর দিয়েছেন উদ্বাস্তু ঠেকানোর জন্যে । কলরাডো সীমান্তকেও সুরক্ষিত করতে চাইছেন ।
মানুষ তো লক্ষ লক্ষ বছর ধরেই উদ্বাস্তু। ১৯ লক্ষ বছর আগে ‘হোমো-ইরেক্টাস মানুষও ছিল মাইগ্রেটেড। আড়াই লক্ষ বছর আগে আমাদের প্রজাতি “হোমো-স্যাপিয়ান্সের জন্ম আফ্রিকায়। ৭০ হাজার বছর আগে তারা আফ্রিকা ছেড়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। তার পরেও তারা আফ্রিকা ছেড়েছে। মানুষ ছিল যাযাবর , বাস্তবিকই আদি বাসিন্দা বলে কেউই কোথাও কোনদিন ছিল না ।
পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ আজ উদ্বাস্ত।আশঙ্কা রোবটের কারণে আগামীদিনে কাজ হারাবে কোটি কোটি মানুষ । উন্নত প্রযুক্তির কারণে মানুষের শ্রম অনুৎপাদী হয়ে উঠছে। মানেই, পুঁজির প্রয়োজনে তার ব্যবহার না হলে পুঁজি সেইসব মানুষের দায়িত্ব নেবে না। আর সেজন্যেই সব দেশেই নাগরিক আইন লাগু করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুঁজিবাদী দেশগুলো। বেসামাল পৃথিবী জনভারে। সঙ্কটের ভারে মুহ্যমান পুঁজি, তাই এত তার আগ্রাসী মনোভব।
আমাদের প্রস্তাব
আসামে যে তাণ্ডব করা হয়েছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গে NRC বা দেশজুড়ে NRIC-র ক্ষেত্রেও যে ইচ্ছাকৃত বদমায়েশি করা হবে না, এমনটা ধরে নেবার কোনো কারণ নেই। আর সেই খেলা শুরু হবে NPR এবং আগামী সেনসাসের তথ্য সংগ্রহের সময় থেকেই। এক্ষেত্রে গণ-উদ্যোগ, গণ-সচেতনতা এবং আইনি প্রক্রিয়া, তিনটিরই সমন্বয় রাখতে হবে। ঘটনা ঘটে গেলেই কিন্তু যারা ভুক্তভোগী হবেন, তারা বাকিদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। তাই যাবতীয় সক্রিয়তা নিতে হবে আগেই।আন্দোলন ছাড়া অন্য কোন পথ আপাতত খোলা নেই জনগণের সামনে । আপাতত অপেক্ষা এই শীতকালীন অধিবেশনে ক্যাব ২০১৬ বা সংশোধিত ক্যাব পাশ করায় কিনা সরকার ।
মিলি মুখার্জী