কালাগ্নি রুদ্র
ভারতে প্রতিবছর ২ থেকে ৮ই অক্টোবরের মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর সুরক্ষা এবং সংরক্ষণের লক্ষ্যে বন্যপ্রাণী সপ্তাহ পালিত হয়। ১৯৫৭ সালে প্রথম বন্যপ্রাণী সপ্তাহ পালিত হয়েছিল।এর ইতিহাসটা এই রকম – ১৯৫২ সালে ভারতে ওয়াইল্ডলাইফ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া গঠিন ও ভারতের বন্যপ্রাণী রক্ষার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বন্যপ্রাণী সপ্তাহ পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।প্রথমে ১৯৫৫ সালে বন্যপ্রাণী দিবস পালিত হয় যা পরে ১৯৫৭ সালে বন্যপ্রাণী সপ্তাহ হিসাবে আপগ্রেড করা হয়। মানুষ তার স্বার্থের জন্য নির্বিচারে প্রকৃতির শোষণে এমনই নিমজ্জিত যে তার কোন ধারণাই নেই, সে তার সাথে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ জীবেদের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কতটা কঠিন করে তুলছে। আমরা আমাদের সুযোগ-সুবিধা এবং তথাকথিত উন্নয়নের নামে, পৃথিবীতে মজুত সম্পদকে এমনভাবে ম্যানেজ ও এক্সপ্লয়েট করেছি যে অন্যান্য জীবের জীবনের ভিত্তিই শেষ হয়ে গেছে। উন্নয়নের সবচেয়ে ভয়াবহ শিকার হয়েছে বন-জঙ্গল। কত প্রাণী ও পাখির প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং কতশত বিলুপ্তির পথে।
প্রাণীকে নিছক পশু হিসেবে বিবেচনা করবেন না, বরং এটিকে আপনার অস্তিত্ব রক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করুন-
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার কর্মশালা, সেমিনার এবং সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে, কিন্তু বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তির হার কমেনি। প্রকৃতি পৃথিবী থেকে বায়ুমণ্ডল পর্যন্ত বিস্তৃত জীববৈচিত্র্যের এত সুন্দরভাবে বিকশিত ও পরিচালনা করেছে যে কোন একটি প্রজাতির অস্তিত্ব যদি বিপদে পড়ে তাহলে সমগ্র জীব-জগতের ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে। পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ এমন পরিবেশের অনুকুলয়ে হয়েছে, যেখানে জল, জঙ্গল, জমি এবং প্রাণী সবাই একে অপরের সাথে সংযুক্ত। এক কথায় ভারত একটি জৈবিক হটস্পট। বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের ৭% -এরও বেশি ভারতে পাওয়া যায়। ভারতের পশু সম্পদও অবিশ্বাস্যভাবে বৈচিত্র্যময়। এটি বিশ্বের প্রাণীর ৭.৪%।আমাদের লোভসর্বস্য কাজের ফলেই পৃথিবীতে উপস্থিত সমস্ত বন্য প্রাণীর বিলুপ্তির বিপদ ঘনিয়ে আসছে। অনেক প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং একবার বিলুপ্ত হয়ে গেলে তাকে আর ফিরিয়ে আনার কোন উপায় নেই। প্রকৃতিতে, তৃণভোজী, অটোট্রফ, সর্বভুক, মাংসাশী ইত্যাদি অসংখ্য জীবের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত খাদ্য শৃঙ্খল প্রাকৃতিক ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীতে মানুষ সহ সকল জীবের অস্তিত্ব একে অপরের সহাবস্থানের উপর টিকে আছে।
উন্নয়নের জন্য প্রকৃতির ধ্বংস বন্ধ করতে হবে-
সরকারের নিষ্ঠুরতা কেবল মানুষকেই সহ্য করতে হয় না , এই নিষ্ঠুরতা দেশের উদ্ভিদ ও প্রাণীরাও সহ্য করে -ভারত-নেপাল সীমান্তে ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা তৈরিকরার জন্য ৫৫ হাজারেরও বেশি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে । এই রাস্তাটি দুধওয়া টাইগার রিজার্ভ, পিলিভিত টাইগার রিজার্ভ, করতনিয়াঘাট বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, সুহেলওয়া বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, সোগাহী বারওয়া অভয়ারণ্য দিয়ে গেছে।এগুলো সবই বাঘেদের বাসস্থান। এগুলি ভারতের সেই বিশেষ স্থানের অন্তর্ভুক্ত যেখানে বাঘ অবাধে বিচরণ করে। বাঘ ছাড়াও চিতাবাঘ, হরিণ, জলাভূমি হরিণ, দাগযুক্ত হরিণ, হগ হরিণ, বার্কিং হরিণ এবং বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ ও পাখি এখানে বাস করে। জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা , জঙ্গলকে দুটি ভাগে ভাগ করে এবং বন্যপ্রাণীদের প্রাকৃতিক আবাস কেড়ে নেয়। রাস্তা পার হওয়ার জন্য, তারা দ্রুত চলমান যানবাহন থামার জন্য অপেক্ষা করবে এবং যারা তাড়াহুড়ো করবে তারা যানবাহনে পিষ্ট হবে। আবার প্রাকৃতিক বাসস্থান হারিয়ে এরা মানুষের বসতির দিকে চলে আসে , তখন মানুষ তাড়া করে এদের মেরেও ফেলে । আপনারা কেউ কেউ বলতে পারেন যে রাস্তা তো তৈরি করতে হবে। নইলে উন্নয়ন হবে কিভাবে ? কিন্তু, আমাদের খুব সতর্কতার সাথে উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। উন্নয়ন অন্ধ নয়। বিকাশ করার সময়, আমাদের প্রকৃতি, পশু -পাখি এবং জঙ্গলের যত্ন নেওয়া উচিত। অন্যথায়, আজকের উন্নয়ন দশ-বিশ বছরের মধ্যেই ধ্বংস হিসেবে প্রমাণিত হবে।বনের মধ্য দিয়ে যাওয়া রাস্তাগুলোকে উঁচু করলে , বন্যপ্রাণীরা কম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং গাছ কাটারও প্রয়োজন কম হয়। সর্বোপরি, এই সব জঙ্গলে থাকা পাখিদের কী অপরাধ, যারা গাছ কাটার কারণে গৃহহীন হয়ে পড়ে এবং তাদের বাসা নির্মাণ এবং সন্তান লালন -পালনের সমস্যা দেখা দেয় । একটি সামগ্রিক চিন্তা ভাবনার নাম উন্নয়ন কিন্তু, এখানে শুধুমাত্র একটাই চিন্তা , তা হল মুনাফা।
অন্য সমস্ত আইনের মতোই , ভারতে বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইনের অবস্থাও একই-
মানব সভ্যতা প্রকৃতির বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং নিজেকে প্রকৃতির চেয়ে বেশি শক্তিশালী প্রমাণ করতে ব্যস্ত, এটা জেনেও যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পরও সে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না।
যতক্ষণ না সমাজের সমস্ত শ্রেণীর কাছে এই বার্তা পৌঁছাবে যে -প্রকৃতি, মানুষ, উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতকে সমান অধিকার দিয়েছে এই পৃথিবীতে বসবাসের , ততক্ষন এদের সুরক্ষা করার দায়িত্ব যে মানুষেরই তা মানুষ মনে করবে না। এবং যদি এটা বাস্তবে ঘটে তবেই বন্যপ্রাণী সপ্তাহ পালনের উদ্দেশ্য সফল হবে নচেৎ নয় ।