বস্তার আজকাল আদিবাসী মহিলাদের আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সোনি সোরি, মারকাম হিদমে, কাওয়াসি হিদমেকে আজ কে না জানে, কারণ এই তিনজনই নির্মম পুলিশী নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, এবং তাও শুধু এই কারণে যে তারা বন বাঁচাতে আন্দোলন করেছিলেন।
পুলিশ হেফাজতে সোনি সোরির যৌনাঙ্গে পাথর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, মুখে দাহ্য রাসায়নিক ঘষে দেওয়া হয়েছিল, বহু মামলা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এত কিছুর পরও তারা সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী কন্ঠস্বর। তাদের লড়াই আজ জঙ্গল বাঁচানোর বাইরে গিয়ে দেশ বাঁচানোর লড়াইয়ের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। আদিবাসী নারীরা নীরবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে যান, মানুষ তাদের লড়াই বড় একটা জানতে পারেনা।
বস্তারের ‘বিপ্লবী আদিবাসী মহিলা সংগঠন’ সম্পর্কে মানুষ তখনই জানতে পেরেছিল যখন বিশিষ্ট লেখিকা অরুন্ধতী রায় 2010 সালে বস্তার মাওবাদী এলাকা পরিদর্শন করার পর ‘আউটলুক’ ম্যাগাজিনে একটি আর্টিকেল লেখেন এবং বলেন যে নব্বই হাজার সদস্যের, এটি সম্ভবত ভারতের বৃহত্তম মহিলা সংগঠন। তিনি লিখেছেন যে জঙ্গলের কর্পোরেট লুট এবং সরকারী অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি, এই সংগঠনটি আদিবাসী সমাজের মধ্যে প্রচলিত পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যও কাজ করে। ভারতীয় ইতিহাস আদিবাসী বিদ্রোহে পরিপূর্ণ। তারা প্রকৃতিকে তাদের পূর্বপুরুষ মনে করেন এবং কখনো কারো দাসত্ব মেনে নেননি। 1857 সালের বিদ্রোহের আগে, আদিবাসীরা ব্রিটিশ শাসনের জঙ্গলে অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে এবং মহাজন ও সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এর মধ্যে ‘হুল’ ও ‘উলগুলান’, ‘ভূমকাল’-এর মতো বিদ্রোহও ইতিহাসে লেখা আছে, কিন্তু সারা দেশে এরকম শত শত বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, যার উল্লেখ নেই ইতিহাসে।
১৭৬৭ থেকে ১৭৭২ এবং আবার১৭৯৫ থেকে১৮১৬ পর্যন্ত চলা চুয়াড় বিদ্রোহকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের প্রথম বিদ্রোহ বলে মনে করা হয়। এটি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আন্দোলনকে দমনের জন্য ব্রিটিশরা তাদের এলাকায় সামরিক ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করে এবং বর্বর দমন-পীড়ন শুরু করে। পুরুষদের বন ও পাহাড়ে লুকিয়ে থাকতে হতো। আদিবাসী মহিলারা রাতের অন্ধকারে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে পুরুষদের কাছে খাবার এবং ধারালো অস্ত্র, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৌঁছে দিত।
সিনগি দাই, চম্পু দাই এবং কাইলি দাই ছিলেন রোহতাসগড়ের রাজকন্যা। কাইলি দাই ছিলেন সেনাপতির কন্যা। তিনজনই ওরাওঁ উপজাতির। চতুর্দশ শতাব্দীতে, আফগান তুর্কিদের বিরুদ্ধে এই তিনজনে তাদের সম্প্রদায়ের মহিলাদের একত্রিত করে, মাথায় পাগড়ি পরে পুরুষের ছদ্মবেশে, হাতে তলোয়ার নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে, একই রাতে তিনবার তাদের বাহিনীকে সোন নদীর ওপারে তাড়িয়ে এসেছিল।এই তিনবার পরাজিত করার স্মরণে ওঁরাও নারীরা ‘জানি শিকার’ নামে একটি উৎসব পালন করেন। ১৮২৭-৩২ সালের মধ্যে, ছোটনাগপুরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কোল বিদ্রোহ হয়েছিল। এটি সিংভূম, পালামু, হাজারিবাগ, মানভূম প্রভৃতি এলাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিদ্রোহের নামের অর্থ এই নয় যে এই বিদ্রোহে শুধুমাত্র কোল সম্প্রদায় জড়িত ছিল। এই এলাকার মুন্ডা, ওরাওঁ, হো এবং মাহালি সম্প্রদায়ও এই বিদ্রোহের অংশ ছিল। এর সবচেয়ে বিখ্যাত নেতা ছিলেন বুধু ভগত। তার দুই মেয়ে রুনিয়া-ঝুনিয়াও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন এবং শহীদ হন। ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাঁওতাল ‘হুল বিপ্লব’ ইতিহাসে খুব বিখ্যাত, যার নেতা ছিলেন সিধো-কানু। ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ এবং গিরিডিহের মাঝে ভোগনাডিহ নামে গ্রাম ছিল এর কেন্দ্র। চার ভাই সিধো, কানু, চাঁদ, ভৈরব এবং দুই বোন ফুলো ও ঝানো, সবাই সাহসিকতার সাথে হুলের নেতৃত্ব দেন। এই আন্দোলন স্থানীয় মহাজন ও তাদের লেঠেরদের বিরুদ্ধে শুরু হয়। সিধো-কানুর বোন ফুলো এবং ঝানো আন্দোলনের জন্য মহিলাদের সংগঠিত করে বিদ্রোহকে একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতিগত লড়াইয়ের রূপ দিয়েছিল। তারা মহিলাদের ছোট ছোট গুপ্তচর সমিতি বানিয়ে প্রাপ্ত তথ্য বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার রাস্তা অবলম্বন করে। নিজেদের নেতৃত্বে সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা করে তারা ভোরবেলা ইংরেজদের ক্যাম্প আক্রমণ করে ইংরেজ বাহিনীর ২১ জনকে হত্যা করেন। তাদের বীরত্বের কারণে বীরভূম জেলা সাঁওতালদের নিয়ন্ত্রণে আসে। বেশ কয়েকটি জায়গার নেতৃত্ব নেয় ফুলো-ঝানো। এই বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। অবশেষে ফুলো ও ঝানোকে ধরা হয় এবং আম গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের বীরত্ব ও ফাঁসির কাহিনী আজও সাঁওতালি ভাষায় গানের মাধ্যমে গাওয়া হয়। আদিবাসী সম্প্রদায় এইসব বীরত্বের কথা মুখে মুখে বলে তাদের সন্তানদের ইতিহাস শেখায়। এই বিদ্রোহ শুধু আদিবাসী ইতিহাসেই নয়, ভারতীয় বিপ্লবী ইতিহাসেও একটি বড় ঘটনা। কিন্তু আজ সরকার নিজেই আদিবাসীদের নির্মমভাবে দমন করছে এবং সিধো-কানো, ফুলো-ঝানু দ্বারা অনুপ্রাণিত প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখোমুখি হচ্ছে।
ভগৎ সিং বলেছিলেন – “গোরা ব্রিটিশদের জায়গায় কালো ব্রিটিশরা এলেও কোনো পার্থক্য হবে না।” এটি মূলধারার লোকেরা ভালভাবে বুঝতে না পারলেও, আদিবাসীরা পেরেছিল। তাই তারা সামন্ত প্রভু এবং কালো ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আজও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
মিলি মুখার্জী