ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আক্রমণের প্রথম ৩০ দিনে, গাজা উপত্যকায় বিমান হামলা ও প্রবেশের মাধ্যমে ১১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে ৪৫ শতাধিক শিশু।
এই ৩০ দিনে ২৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছে না। ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞের কারণে গাজার মোট ২৩ লাখ জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ দেশান্তরিত হয়েছে। গাজা উপত্যকায় এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ইসরাইল বোমাবর্ষণ করেনি।
বিমান হামলায় ধ্বংসযজ্ঞের পর এখন গাজায় ঢুকে পড়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
হাসপাতাল ঘেরাও করে হামলা চালানো হচ্ছে, প্রাণ হারাচ্ছে নবজাতক শিশুরা। গাজা উপত্যকায় জল,খাদ্য সামগ্রী, তেল ইত্যাদির ব্যাপক ঘাটতি। ওষুধের সংকটের কারণে বড় হাসপাতালগুলো আহতদের ভর্তি করা বন্ধ করে দিয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের এই নিপীড়ন, সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
জনগণের এই ক্ষোভের ফলে গত এক মাস ধরে সারা বিশ্বে ইসরায়েলি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদ করে চলেছে।
লক্ষণীয় যে, সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ হচ্ছে সেইসব দেশে, যাদের সরকার সরাসরি ইসরায়েলকে সমর্থন করছে। সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ এসব বিক্ষোভে উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণ করছে, এর বিশাল একটা অংশ ছাত্র ও প্রগতিশীল সংগঠনের।
৪ঠা নভেম্বর সারা বিশ্বে পালিত হয়েছে ‘ফিলিস্তিনের সঙ্গে জাতীয় সংহতি দিবস’। এই উপলক্ষে, ইসরায়েলিদের পরিচালিত গণহত্যা ও হামলা অবিলম্বে বন্ধের দাবিতে এবং ফিলিস্তিনের জাতীয় মুক্তির সমর্থনে বিশ্বের ৩০০ টিরও বেশি বড় বড় শহরে বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হয়।
ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ৩ লাখেরও বেশি মানুষ জড়ো হয়েছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং স্লোগান দেয় “বাইডেন! আপনি লুকাতে পারবেন না!”
যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ফিলিস্তিনের সমর্থনে বিক্ষোভ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেষবার এত বড় বিক্ষোভ হয়েছিল ২০০৩ সালে যখন আমেরিকা ইরাকে আক্রমণ করেছিল।
কানাডায়, কিংস্টন, অটোয়া, টরন্টো এবং উইনিপেগ সহ প্রায় ৩০টা শহরে বিশাল বিক্ষোভে ‘ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করো’ স্লোগান প্রতিধ্বনিত হয়েছিল।
ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী দেশ মিশরে ট্রেড ইউনিয়নগুলো ও প্যালেস্টাইনপন্থী সুশীল সমাজ কমিটি ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে। এবং গাজার একমাত্র রাফাহ সড়ক পুরোপুরি খুলে দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
ফিলিস্তিনের জাতীয় মুক্তির সমর্থনে তিউনিসিয়ার রাজধানীতে ট্রেড ইউনিয়ন এবং প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর দ্বারা এক বিশাল বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়েছে। যা ইসরায়েলের সঙ্গে যেকোনো ধরনের সম্পর্ক রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞার দাবি জানিয়েছে। বিক্ষোভের চাপের কারণে তিউনিসিয়া সরকারকে এ বিষয়ে কিছু তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
মরক্কোতেও ইসরায়েল এবং ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানো মরক্কো সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বহু শহরে বিক্ষোভ করেছে।
তুর্কিতে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। এরকমই একটা বড় বিক্ষোভের সময়, লোকেরা আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ করেছিল।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই বড় ধরনের বিক্ষোভ দেখা গেছে।
ঘানা, সেনেগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি আফ্রিকান দেশগুলোতে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে। ৪ নভেম্বর এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও একই ধরনের বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছিল।
৪ নভেম্বর ইউরোপের প্রতিটি দেশে বিক্ষোভ হয়। ইতালিতে ট্রেড ইউনিয়ন ও জনগণের সংগঠনের আহ্বানে রাজধানী রোমে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ জড়ো হয়ে ফিলিস্তিনের জাতীয় মুক্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে ইতালি সরকারের সামরিক অংশীদারিত্বের অবসানের দাবি জানিয়েছে। এছাড়া মিলানেও ১০ হাজারের বেশি মানুষ জড়ো হয়েছে। ইতালির নেপলস শহরে ছাত্রদের ক্ষোভ এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে তারা কিছু সময়ের জন্য একটি ইমারতই দখল করে রাখে।
ফ্রান্সে শতাধিক ট্রেড ইউনিয়ন ও গণসংগঠন বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করেছে। রাজধানী প্যারিসে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ জড়ো হয়।
জার্মানিতেও রাজধানী বার্লিনসহ অনেক শহরে ইসরায়েল ও তার সহযোগী জার্মানির শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ফেটে পড়ে।
ব্রিটেনেও একই দিনে রাজধানী লন্ডনসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে।
নভেম্বর মাসেও ৪ তারিখের পর লাগাতার বিক্ষোভ হয়েছে। এছাড়াও, ১১নভেম্বর বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে বিশাল বিক্ষোভ হয়েছে। ১১ নভেম্বর বিক্ষোভে জড়িত লোকের সংখ্যা ৪ নভেম্বরের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
এসব বিক্ষোভে গাজায় ইসরায়েল কর্তৃক মানবতা হত্যার বিরুদ্ধে এবং ইসরায়েলকে সমর্থনকারী তাদের দেশের সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা গেছে।
যদিও এই বিক্ষোভগুলো সারা বিশ্বে হয়েছিল, তবে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ হয়েছিল যুক্তরাজ্যে। এই বিক্ষোভের নাম দেওয়া হয় ‘ন্যাশনাল মার্চ ফর দ্য লিবারেশন অফ ফিলিস্তিন’। এই মিছিলে যোগ দিতে রাজপথে নেমেছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। এ বিক্ষোভে দেশের বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ, শিক্ষার্থী, কর্মচারী ও নারীরা অংশ নেন।
ইউকের মানুষ ইসরায়েলের সাথে সরকারের সম্পৃক্ততার তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং সরকারের নেতৃত্বদানকারী ঋষি সুনাকের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। যদিও ইসরায়েলকে সমর্থনকারী ডানপন্থী দলগুলিও এই দিনে ইচ্ছাকৃতভাবে নেমেছিল, তবে তাদের সংখ্যা এক হাজারের বেশি ছিল না।
ইসরায়েলের নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে যে বিক্ষোভ চলছে তা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে বিশ্বের শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ফিলিস্তিন এবং এর জাতীয় মুক্তির সমর্থনে দাঁড়িয়েছে।
মিলি মুখার্জী