হকিং, যিনি আইনস্টাইনের পরে আধুনিক সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, 1965 সালে তার বান্ধবী জেন বেরিল ওয়াইল্ডকে বিয়ে করেছিলেন।প্রথম দেখা হয়েছিল রেলস্টেশন প্ল্যাটফর্মে পরে এক ঘরোয়া পার্টিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মেয়েটি তখনো টিনএজার আর দ্বিতীয় সাক্ষাতেই প্রেম ! কিছুদিন পরেই ধরা পড়ে ছেলেটির মারণ রোগ, তীব্র অবসাদ গ্রাস করে তাকে । সব জেনেও সরে যায়নি জেন ওয়াইল্ড উল্টে বিয়েটা তাড়াতাড়ি করে ফেলেছিলেন। নিশ্চিত ছিলেন না, কতদিন বাঁচবেন স্টিফেন হকিং !
চিরকাল হুইলচেয়ারে আবদ্ধ প্রতিভা যিনি হাঁটতে বা কথা বলতে অক্ষম ছিলেন, তাঁর প্রেমের গল্প কল্পনাতীতভাবে প্রাণবন্ত এবং ঝড়ো ছিল। সময়ের সাথে সাথে স্টিফেনের স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। তাদের বিবাহিত জীবন একেবারেই ভালো ছিল না।বিয়ের দিন অসুস্থ বরের হাতে ছিল একটা লাঠি ।ধীরে ধীরে অথর্ব ও কুৎসিত হয়ে উঠেছেন স্বামী। কিন্তু তাঁকে সামলে রেখেছেন হৃদয় দিয়ে, তিন সন্তানের সঙ্গে।
প্রায় তিন দশক ধরে, জেন স্টিফেনকে খাওয়ানো, পোশাক পরানো, স্নান করানো এবং তাকে অসংখ্যবার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজগুলো করেছেন। এর মধ্যে স্টিফেনকে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে টেনে নেওয়ার অভিজ্ঞতাও ছিল বহুবার। এই সময়টাতে জেনের ভিতরের নারী সত্তাকে হত্যা করেছিল সে এবং বারবার তার স্বাধীন পরিচয় সম্পর্কে ডিপ্রেসনে চলে যেত। যত বিখ্যাত হচ্ছেন স্বামী, সুবিধেবাদীদের ভিড় বাড়ছে তত। স্বামীর কাছ থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। তিনি নিজে লেখক, পিএইচডি করেছিলেন স্প্যানিশ কবিতায়। তার মধ্যেই স্বামীকে দেখাশোনা করছেন আর বুঝতে পারছেন অসুস্থ স্বামী প্রেম করছেন এক নার্সের সঙ্গে। 1985 সালে স্টিফেনের একটি অপারেশনের পর, স্টিফেন এবং হাসপাতালের নার্স এলেন ম্যাসনের মধ্যে প্রেম শুরু হয়। ফ্ল্যামবয়েন্ট এলেনের স্কেটবোর্ডিংয়ের প্রতি আবেগ ছিল এবং ফ্লার্টিং উপভোগ করতেন। তিনি স্টিফেনের প্রাণবন্ততায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এলেন বিবাহিত ছিলেন এবং তার স্বামী, একজন ইঞ্জিনীয়র,স্টিফেন হকিংয়ের ভক্ত ছিলেন এবং তার জন্য একটি স্পিচ সিনথেসাইজার তৈরির প্রোজেক্টের সাথে জড়িত ছিলেন। সেই সময় জেন কে এক বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিলেন, গান শেখার জন্য। গান শিখতে গিয়ে ক্যামব্রিজ চার্চের সংগীতশিল্পী জোনাথন হেলার জোন্সের প্রেমে পড়েন জেন। স্টিফেনকে যখনই বক্তৃতা দিতে বিদেশে যেতে হতো, তখনই এলেন তার সঙ্গে যেতেন। তিনি স্টিফেনের অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রেমে পড়েছিলেন। কিছুদিন পর জেন তার স্বামী স্টিফেনকে তাদের প্রেমের কথা জানায়। স্টিফেনও তাকে এলেন সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। দুজনের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয় যে পুরো বিষয়টি গোপন ও ব্যক্তিগত রাখা হবে এবং তাদের সন্তান-প্রেমিকাসহ সবাই এক ইউনিট হিসেবে একসাথে থাকবে। এই পরিবারটি, মহাকাশের যেকোন নক্ষত্রমণ্ডলের মতোই জটিল, 1990 সাল পর্যন্ত এক ছাদের নিচে একসাথে ছিল। তবু হকিং তাঁর নার্স ইলায়েন ম্যাসনকে বিয়ে না করা পর্যন্ত জেন বিয়ে করেননি। স্টিফেন এবং জেন 1995 সালে বিবাহবিচ্ছেদ করেন। একই বছর এলেন এবং স্টিফেন হকিং বিয়ে করেন। জেন এবং জোনাথন হেলার 1997 সালে বিয়ে করেছিলেন। তিন সন্তানের মা জেন দ্বিতীয় বিয়ে তো করলেন কিন্ত সর্বক্ষণ স্টিফেনের অসহায় মুখ ভাসতো চোখের সামনে । অশান্তির ভয়ে পুরোনো বাড়িতে যেতে পারতেন না, তাই দুদিন অন্তর ছুটে আসতেন অসুস্থ অথর্ব প্রাক্তন স্বামীকে দেখতে তাঁর অফিসে।
এবার নার্স হওয়ার সাথে সাথে এলেন একজন স্ত্রীও, স্টিফেনের প্রিয় খাবার রান্না করতে তার ভালো লাগত। সমস্ত মেশিনের সাথে সংযুক্ত স্টিফেনের শারীরিক অবস্থা এমন ছিল যে দুজনে একসাথে ঘুমাতে পারত না, যদিও এলেন রাতে অনেকবার স্টিফেনকে দেখতে এবং স্পর্শ করতে আসত।
এলেন লেনার্ড ম্লোডিনভকে বলেছিলেন – “আমি স্টিফেনকে সাহায্য করেছি কিন্তু সেও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে, স্টিফেনের ভালবাসার অনুভূতি ছিল বিশেষ।
তা সত্ত্বেও, এই সম্পর্ক তীব্রভাবে বিতর্কিত ছিল। স্টিফেনের সন্তানরা একটি পুলিশ কেস করেছে যে এলেন তাদের বাবার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করছে। চার বছর ধরে তদন্ত চললেও অ্যালেনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি পুলিশ।পুলিশের হাত থেকে দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাঁচাতে হকিং অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন এবং ২০০৬ সালে ডিভোর্স দিয়ে দেন । তার পরই জেনের সঙ্গে আবার যোগাযোগ। দ্বিতীয় বিয়ের পর প্রথম স্বামীকে নিয়ে বই লিখেছিলেন ভদ্রমহিলা…মিউজিক টু মুভ দ্য স্টার্স: এ লাইফ উইথ স্টিফেন ।
ওই বই থেকেই বিখ্যাত সিনেমার সৃষ্টি–দ্য থিওরি অফ এভরিথিং’। সেই সিনেমার পুরস্কার পাওয়ার দিন হকিংকে হুইল চেয়ারে ধরে পরম মমতায় যিনি আনছিলেন তিনি তাঁর অত্যন্ত এক আপনজন, যদিও এখন পরস্ত্রী…জেন ওয়াইল্ড জোন্স।
যদিও পরিবারের কাছের লোকেরা তখনও বিশ্বাস করত যে এলেন এবং স্টিফেনের সম্পর্ক অত্যন্ত ঝোড়ো আবেগপূর্ণ ছিল। কখনও দুজনেই একে অপরের চিরন্তন ভালবাসার জন্য শপথ করত, কখনও তারা একে অপরকে আজীবন না দেখার হুমকি দিত।
এক রাতে লেনার্ড ম্লোডিনভকে ডিনারের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। খাওয়ার মাঝখানে এলেন চিৎকার করে বললো- “আমি বিশ বছর ধরে এই লোকের দাসি হয়ে আছি। এখন বিষয়টি সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। পরে এলেন তার ক্ষোভের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন।দ্বিতীয় স্ত্রী ম্যাসনের সঙ্গে হকিংয়ের বিয়েটা টিকেছিল দশ বছর।
হকিংয়ের মৃত্যুর পর অ্যালেন লেনার্ড ম্লোডিনভকে বলেছিলেন – “তিনি একজন অভিনেতার মতো ছিলেন। প্রতিবারই তাকে কথোপকথনের কেন্দ্রবিন্দু হতে হয়েছে। তাকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু হতে হয়েছিল। তিনি এসব পছন্দ করতেন, এটি তাকে শক্তি দিয়েছে। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। তার জীবন খুব কঠিন ছিল কিন্তু তিনি একজন অকল্পনীয় সাহসী মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো অভিযোগ করেননি।
এলেন এবং স্টিফেনের 2006 সালে বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার পর এবার স্টিফেন প্রেমে পড়েন আরেক নার্স ডায়ানা কিং-এর। ডায়ানা, গুরুতর বিষণ্নতার শিকার, স্টিফেনের চেয়ে 39 বছরের ছোট ছিলেন। এছাড়াও, ডায়ানা বুদ্ধিমান এবং শিক্ষিত ছিলেন। স্টিফেন তার সাথে কথা বলে আনন্দ পেতেন। তিনি তাকে নতুন নতুন জিনিস শেখাতেন এবং বলতেন।
দুজনেই এনগেজমেন্ট করে ফেলেন কিন্তু তার পরেই চিন্তিত হয়ে পড়েন স্টিফেন। তিনি অনুভব করতে শুরু করেছিলেন যে এই বিয়ে তার সন্তানদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করবে। তিনি পিছিয়ে যান, এবং এই সিদ্ধান্ত ডায়ানার ব্যক্তিগত জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছিল কিন্তু সে বারবার বলেছিল – “পৃথিবীতে এমন অভিব্যক্তিপূর্ণ মুখ আর কারো ছিল না। আমি তার মুখের নড়াচড়া দেখেই বলতে পারতাম সে কী ভাবছে। 2018 সালের 14 মার্চ স্টিফেন হকিং মারা যান। আশ্চর্যের কিছু নেই, নারীদের বিশ্বের সবচেয়ে বড় রহস্যের কথা বলা স্টিফেন হকিংয়ের স্টাডিতে মেরিলিন মনরোর পোট্রেট লাগানো থাকত।
কালাগ্নি রুদ্র
Like
Comment