উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর তুলনায় ভারতে নারীমুক্তির প্রশ্ন একটু বেশিই জটিল।
এখানে পুঁজিবাদের বিকাশ কম হওয়ায়, পুরানো সামন্ততান্ত্রিক পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক শক্তিশালী, এখানে শ্রেণির পাশাপাশি বর্ণ, ধর্ম ও জাতীয়তার প্রশ্ন নারীমুক্তির প্রশ্নকে আরও জটিল করে তোলে।
এদেশে নারীর মর্যাদার বৈচিত্র্য বোঝা যায় উচ্চ পুঁজিবাদী শ্রেণীর শাসক নারীদের দলিত শ্রমজীবী নারী, বিশেষ করে মুসলিম দলিত শ্রমিক নারীদের সাথে তুলনা করলে। এই বৈচিত্র্য ও জটিলতা এখানকার নারী মুক্তির প্রকল্পে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
আগে শাসক শ্রেণীর নারীদের কথাই ধরুন। বলাই বাহুল্য যে শাসক শ্রেণী হওয়ার কারণে তাদের অবস্থান সম্পদশালী ও সুবিধাপ্রাপ্ত।তারা নিজেদেরকে শাসক শ্রেণীর বলে মনে করে এবং শ্রমিক শ্রেণীর মহিলাদের সাথে কোন ঐক্য অনুভব করে না। তারা কর্মজীবী নারীদের তখনই মনে রাখে যখন তাদের নিজেদের স্বার্থে তাদের প্রয়োজন হয়।
এমনকি নারীদের হয়রানির সুস্পষ্ট ক্ষেত্রেও তারা তাদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে প্রতিক্রিয়া জানায়। একই কথা প্রযোজ্য সিনেমা, খেলাধুলা বা অন্যান্য ক্ষেত্রের সুপরিচিত নারীদের ক্ষেত্রে যাদের আজকের পুঁজিবাদী সমাজে অনেক প্রভাব রয়েছে – সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি ‘ফলোয়ার’ রয়েছে।
এতদসত্ত্বেও বলা যায় না যে ভারতে শাসক শ্রেণীর নারীদের অবস্থান পুরুষের সমান হয়েছে, বৈষম্য আছেই। বড় কর্পোরেট সেক্টরে নারীরা পুরুষদের থেকে অনেক পিছিয়ে। এমনকি রাজনীতিতেও (এমপি, বিধায়ক, মন্ত্রী) তাদের সংখ্যা খুবই কম। সিনেমা, খেলাধুলা, মডেলিং ইত্যাদিতে তাদের আয় পুরুষের তুলনায় কম। এই সমস্ত জায়গায় একটি কাঠামোগত বৈষম্য এখনও বিদ্যমান যদিও এই শ্রেণীর সমস্ত মানুষ লিঙ্গ সমতার জন্য গলা ফাটায়। হয়ত এই শ্রেণীর মহিলারা খুব কমই সরাসরি হয়রানি বা বৈষম্যের সম্মুখীন হয়, তবে পুরানো পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবশিষ্টাংশ এখনও বৈষম্যের কাঠামোগত পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে।
জনজীবন বা সামাজিক শ্রমে অর্থপূর্ণ ভূমিকা ছাড়া প্রকৃত অর্থে নারীমুক্তি অগ্রসর হতে পারে না। এই প্যারামিটারের দিকে তাকালে দেখা যায়, শাসক শ্রেণীর নারীদের একটি অংশ এখনও এ দিকে এগোয়নি। এই মহিলারা ‘গৃহস্থ’ এবং সামাজিক জীবনে তাদের ভূমিকা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা সামাজিক হওয়ার মধ্যে তাদের অর্থ খুঁজে পায়।এদের তুলনায় শাসক শ্রেণীর সেই সব নারী যারা কোনো না কোনো ব্যবসায্র সাথে যুক্ত আছেন তাদের অবস্থা ভালো।ব্যবসাই যদি তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হয়, তবে তাদের আয় তুলনামূলক কম হলেও তারা এক্ষেত্রে পুরুষের সমান হয়ে যায়।
শাসক শ্রেণীর মহিলাদের মধ্যেও বর্ণ, ধর্ম এবং জাতীয়তার বিভাজন রয়েছে এবং এগুলি কখনও কখনও তাদের একত্র হতে বাধা দেয়। শাসক শ্রেণীর লোকেরাও তাদের অন্যান্য স্বার্থে এই বিভাজনকে ব্যবহার করে। সংসদ ও বিধানসভায় নারী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তা দেখা যায়।এখানে এটি পুরুষ বনাম নারীর বিষয় নয় যতটা রাজনীতির অন্যান্য সমীকরণ যা শাসকদের মধ্যে বর্ণ বিভাজনের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। শাসকদের মধ্যে জাতিগত বৈরিতা শাসক শ্রেণীর নারীদের উত্থানের পথে চলে আসে।
শাসক শ্রেণীর নারীদের সেই শ্রেণীর পুরুষদের তুলনায় বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও তাদের সাথে শ্রমিক শ্রেণীর নারীদের মধ্যে কোনো ঐক্য তৈরি হয় না।তাদের মধ্যে কোনো বন্ধুত্ব হয়না, যা থাকে তা শুধু শোষণ আর নিপীড়নের সম্পর্ক। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি শাসক শ্রেণীর নারীদের মনোভাব শাসক শ্রেণীর পুরুষদের চেয়েও খারাপ হয়। তাদের বৈষম্য ইস্যুতে, তারা কেবলমাত্র আরও বেশি সংখ্যক কর্মজীবী মহিলাদের ব্যবহার করার দিকে অগ্রসর হতে পারে।
আমাদের ধ্রুপদী রূপে নারীদের প্রশ্ন সেই মধ্যবিত্ত নারীদের প্রশ্ন, যারা ঘরোয়া জীবনে বন্দী।
নারীমুক্তির প্রশ্নটি শ্রমজীবী মধ্যবিত্ত নারীদের মধ্যে আরেকটি আকারে দেখা দেয় যেখানে নারীমুক্তি কিছুটা হলেও অর্জিত হয়েছে। এখানে মনে রাখতে হবে যে, ইতিহাস জুড়ে কর্মজীবী নারীদের অবস্থা সর্বদা উপরোক্ত দুই শ্রেণীর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল এবং আজও রয়েছে। এর সহজ কারণ হল, তারা সেভাবে সামাজিক শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না।
উপরে উল্লিখিত , মধ্যবিত্ত মহিলাদের মধ্যে দুটি গ্রুপ রয়েছে – গৃহস্থালী এবং কর্মরত। গৃহস্থালী নারীদের অবস্থান খুবই কঠিন (ভারতে অভিজাত শ্রমিকদের স্ত্রীরাও এই শ্রেণীতে পড়ে – নিম্ন মধ্যবিত্তের অংশ হিসেবে)। প্রায়শই নারীবাদীরা যখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নারীদের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন, তাদের চোখে এই সব নারী্রাই থাকে।
সামাজিকভাবে কাটা দেয়ালে বন্দী এই মধ্যবিত্ত নারীদের অবস্থা সত্যিই শোচনীয় – বিশেষ করে মনো-সাংস্কৃতিক অর্থে।শাসক শ্রেণীর ‘সোশ্যালাইট’ নারীদের মতো তাদের নিজস্ব কোনো কণ্ঠস্বর নেই। 1960-70 দশক থেকে, নারীবাদ তাদের শুধুমাত্র একটি কণ্ঠস্বর দিয়েছে। 1980 এবং 90 এর দশকে ভারতে এর অনুরণন শোনা যায়।
শাসক শ্রেণীর মহিলাদের থেকে মধ্যবিত্ত গৃহিণীদের অবস্থান এই বিষয়ে ভিন্ন, যে তাদের সম্পত্তিতে অধিকার নেই। আইনত সম্পত্তিতে তাদের অধিকার থাকলেও বাস্তবে তারা সম্পত্তি পায় না। তারা নিজেরাই পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার দাবি করতে দ্বিধাবোধ করে কারণ তা করলে পৈত্রিক পরিবারের সাথে সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।তারা এত বড় ঝুঁকি নিতে চায় না কারণ পৈতৃক সম্পর্ক তাদের জন্য একটি সমর্থন হিসাবে কাজ করে। এমতাবস্থায় এসব নারী সম্পূর্ণরূপে স্বামীর আয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাই তারা স্বামীর উপর আধিপত্য করার চেষ্টা করে।
পরিবার নামক প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্তিও নারী মুক্তির শর্ত। গৃহশ্রমের পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠান নারীদের একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে আবদ্ধ করে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে। পিতামাতার দ্বারা সন্তান লালন-পালনের একটি পদ্ধতির মাধ্যমে, এটি নিষ্পাপ শিশুদের প্রথমে ছেলে-মেয়ে এবং পরে পুরুষ-মহিলার ছাঁচে ঢালাই করে। যেমনটি বলা হয়েছে, একজন মহিলা জন্মগ্রহণ করেন না বরং তৈরি হন।একইভাবে পুরুষরা জন্মায় না বরং তৈরি হয়। এমতাবস্থায় নারীর মুক্তির জন্য প্রয়োজন শুধু সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে নারীদের পুরুষের সমান অধিকার দিলেই হবে না, সন্তান লালন-পালনের পুরো বিষয়টিকে পরিবার থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে সার্বজনীন দায়রায়, ছেলে মেয়ে এবং পুরুষ ও মহিলার মধ্যে সমতার ধারণার অধীনে।
ভারতে সামন্ততান্ত্রিক অবশিষ্টাংশের অস্তিত্বের অংশ হিসেবে যৌথ পরিবারের অবশিষ্টাংশও রয়েছে।এই যৌথ পরিবারের বোঝাও নারীর ভাগে পড়ে এবং অনেক সময় পরিবারে চরম উত্তেজনার জন্ম দেয়। কিছুটা হলেও, এই সমস্যা শ্রমিকদের পরিবারে বিদ্যমান এবং মহিলা শ্রমিকদের এর মুখোমুখি হতে হয়। এক্ষেত্রেও তারা মধ্যবিত্ত নারীদের মতো অর্থের মাধ্যমে তা মোকাবেলা করতে পারে না।অন্যান্য শ্রেণীর নারীদের মতো শ্রমজীবী নারীদের মধ্যেও জাতি, ধর্ম ও জাতীয়তার বিভাজন বিদ্যমান। এর সাথে স্থানীয় ও বাইরের বিভাজনও রয়েছে।শ্রমিকরা যাতে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে সেজন্য পুঁজিপতিরা ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিভাজন কে প্রশ্রয় দেয়।
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট যে শ্রমজীবী নারীদের মুক্তির জন্য পুরুষের আধিপত্যের বিরুদ্ধে আদর্শিক সংগ্রামের পাশাপাশি কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে, এটা শুধু ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগান দিয়ে করা যাবে না।যে আদর্শগত ও বস্তুগত ভিত্তি কন্যা ভ্রূণ হত্যার দিকে পরিচালিত করে তা দূর করতে হবে।’মেয়েদের শিক্ষিত’ করার জন্য সব শিশুরই প্রয়োজন একটি উচ্চমানের বিনামূল্যের শিক্ষা ব্যবস্থা। এর পরে, একজন শিক্ষিত মহিলার জন্য সমান বেতনে চাকরির প্রাপ্যতা প্রয়োজন। গর্ভবতী হলে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত না করা এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে কাজে ফিরতে পারে।এ জন্য কাজের জায়গায় নার্সারি দরকার। পাড়ায় পাড়ায় পাবলিক শিশু কেন্দ্রের প্রয়োজন রয়েছে যাতে শিশুরা বাড়িতে ফিরে মায়ের বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়। এর পাশাপাশি, সমস্ত জনজীবনে (রাজনীতি ইত্যাদি) মহিলাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে (সংরক্ষণের মাধ্যমে হলেও)।
বেকারত্ব পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য। কদাচিৎ এটা ঘটে যখন বেকারত্ব শূন্যের দিকে চলে যায়, সেটাও খুব অল্প সময়ের জন্য। এমন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার লড়াই কমবেশি সংখ্যক কর্মজীবী নারীকে পতিতাবৃত্তির দিকে ঠেলে দেয়।এই মহিলারা মহিলা দাসত্বের খুব কঠোর পরিস্থিতিতে বাস করে। শ্রমজীবী নারীদের এই পতিতাবৃত্তি ভোগবাদী জীবনের তাড়নায় পুঁজিবাদে সংঘটিত পতিতাবৃত্তি থেকে আলাদা – ‘কল গার্ল’, বিজ্ঞাপন, মডেলিং ইত্যাদি।
এখান থেকেই পুঁজিবাদের অবসানের সঙ্গে নারী মুক্তির প্রশ্ন যুক্ত হয়। মোটকথা, পুঁজিবাদে নারীমুক্তি সম্ভব হলেও বাস্তবে পুঁজিবাদের গতিশীলতা তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পুঁজিবাদে ধীর ও তীব্র সংগ্রামের মাধ্যমেই নারীরা তাদের মুক্তির দিকে এগিয়ে যায়।
কিন্তু এই মুক্তিও কেবল এমন মাত্রায় নিয়ে যায় যে নারীরাও পুরুষের মতো পুঁজির দ্বারা শোষিত হয় এবং তাদের সমান (কমও না বেশি না) পুঁজির দাস হয়। পুরুষ কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার দাসত্বের পাশাপাশি পুঁজির দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে হলে পুঁজির ব্যবস্থা অর্থাৎ পুঁজিবাদেরই অবসান প্রয়োজন।এমতাবস্থায় সামগ্রিক বা প্রকৃত অর্থে মুক্তির জন্য নারীকেও পুরুষের মতো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসানের জন্য লড়াই করতে হবে। তবে সব নারী-পুরুষ এই লড়াইয়ে নামবে না। ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে এটা শ্রমিক শ্রেণীর কাজ, তার ঐতিহাসিক মিশন।আজ নারীমুক্তির প্রশ্নটি বৃহত্তর মানবমুক্তির প্রশ্নের সাথে এই অর্থে যুক্ত হয়েছে যে এটি সীমিত অর্থে শুধুমাত্র পুঁজিবাদের অবসানের সাথে এবং বৃহত্তর অর্থে শুধুমাত্র একটি নতুন শ্রেণীহীন, রাষ্ট্রহীন সমাজে অর্জিত হতে পারে।এই যাত্রায় শ্রমজীবী নারীরাও শ্রমিক শ্রেণীর অংশ হিসাবে শ্রমজীবী পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করবেন। তারা তাদের সীমিত মুক্তির পাশাপাশি বৃহত্তর মুক্তি-মানব মুক্তির জন্য লড়াই করবেন।
মিলি মুখার্জী