সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত অংশে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পরিবর্তনগুলির মধ্যে একটি ছিল মহিলাদের অবস্থার পরিবর্তন।
বিপ্লব নারীদের আইনি ও রাজনৈতিক সমতা প্রদান করেছে। শিল্পায়ন সমান বেতনের অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রদান করেছে।
কিন্তু প্রতিটি গ্রামের মহিলাদের এখনও বহু পুরনো প্রথার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সাইবেরিয়ার একটি গ্রাম থেকে খবর এসেছে যে সম্মিলিত খামারগুলি মহিলাদের সরাসরি তাদের স্বাধীন উপার্জন দিয়েছিল, সমস্ত স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের দ্বারা মারধরের বিরুদ্ধে ধর্মঘট সংগঠিত করেছিল, এইভাবে এক সপ্তাহের মধ্যেই পুরানো প্রথার অবসান ঘটে।
একজন গ্রামের সভাপতি আমাকে বলেছিলেন: ‘আমরা যখন আমাদের গ্রামের সোভিয়েতে প্রথম মহিলা নির্বাচিত করি, তখন পুরুষরা তা নিয়ে খুব মজা করেছিল। কিন্তু তার পরের নির্বাচনে আমরা ছয়জন নারীকে নির্বাচিত করেছি এবং এখন আমরা হাসছি।’
1928 সালে মস্কোতে হওয়া মহিলা সম্মেলনে যাওয়া একটি ট্রেনে আমি সাইবেরিয়ার বিশটি গ্রামের মহিলা অধ্যক্ষদের সাথে কথা বলি। তাদের মধ্যে বেশিরভাগের জন্য এটি ছিল প্রথম ট্রেন যাত্রা। এর আগে শুধুমাত্র একজন মহিলা সাইবেরিয়ার বাইরে গিয়েছিলেন। মহিলাদের দাবি সম্পর্কে ‘সরকারকে পরামর্শ’ দেওয়ার জন্য তাকে মস্কোতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এই কাজের জন্য তার গ্রামীণ মন্ডল তাকে নির্বাচিত করে পাঠিয়েছিল।
নারী স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে কঠিন সংগ্রাম হয়েছিল মধ্য এশিয়ার অঞ্চলে। এখানে নারীদের অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং অল্প বয়সেই তাদের বিয়ে করে স্বামীর কাছে বিক্রি করা হতো।এরপর তারা ‘পরাঞ্জা’ পরেই কেবল জনসম্মুখে যেতে পারতেন, এটি ঘোড়ার চুল থেকে বোনা একটি মুখোশ। এতে পুরো মুখ ঢেকে যায় এবং শ্বাস নিতে ও দেখতে অসুবিধা হয়। প্রথা অনুসারে, তার স্বামীরও অধিকার ছিল মাস্ক ছাড়া বাইরে আসা মহিলাদের হত্যা করার।মুসলিম ধর্মীয় নেতারা অর্থাৎ মোল্লারা ধর্মের মাধ্যমে একে সমর্থন করতেন। এখানে রাশিয়ান নারীরা প্রথম স্বাধীনতার বার্তা নিয়ে আসেন, শিশু কল্যাণ ক্লিনিক খোলেন যেখানে স্থানীয় মহিলারা একে অপরের সামনে তাদের পর্দা সরাতে পারে। এখানে নারীর অধিকার এবং পরদার কুফল নিয়ে আলোচনা করা হোত। কমিউনিস্ট পার্টি তার সদস্যদের চাপ দিয়েছে তাদের স্ত্রীদের নকাব ছাড়া থাকতে দিতে।
1928 সালে যখন আমি প্রথমবার তাসখন্দ যাই, তখন কমিউনিস্ট মহিলাদের সম্মেলনে একটি ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল: ‘পশ্চাতবর্তী গ্রামে আমাদের সদস্যদের অসম্মান করা হয়। তাদের নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। কিন্তু এই বছর আমাদের এই জঘন্য পর্দা দূর করতেই হবে। এটি একটি ঐতিহাসিক বছর হওয়া উচিত। এই রেজুলেশনের পিছনে ছিল হৃদয় বিদারক ঘটনা। তাসখন্দের একটি স্কুল ছাত্রী তার গ্রামে নারী অধিকারের জন্য প্রচার চালাতে তার ছুটি ব্যবহার করেছে।
তার দেহকে টুকরো টুকরো করে একটি গাড়িতে করে স্কুলে ফেরত পাঠানো হয়।গাড়িতে একটি বার্তা লাগানো ছিল: ‘এটি তোমাদের স্বাধীনতার জন্য নারীদের পুরস্কার। অন্য একজন মহিলা স্থানীয় জমিদারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে একজন কমিউনিস্টকে বিয়ে করেছিলেন। জমির মালিকের প্ররোচনায় আঠারোজনের একটি দল গর্ভাবস্থার অষ্টম মাসে মহিলাকে ধর্ষণ করে এবং তার লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
নারীরা তাদের সংগ্রামকে প্রকাশ করার জন্য কবিতা লিখেছেন। মুক্তিযোদ্ধা জুলফিয়া খানকে যখন মোল্লারা জীবন্ত পুড়িয়ে মারে ,তখন তার গ্রামের মহিলারা এই শোকগীতি লিখেছিলেন:
হে নারী, পৃথিবী কখনো ভুলবে না
তোমার স্বাধীনতা সংগ্রাম কে।
আমরা তাদের ভাবতে দেব না
যে এই আগুন তোমাকে মেরে ফেলতে পারে।
যে শিখা তোমাকে পোড়ায়
এখন তা আমাদের হা্তে মশাল হয়ে গেছে।
রক্ষণশীল দমনের দুর্গ ছিল ‘পবিত্র বুখারা’।
এখানে পরদা প্রথার অবসানের আন্দোলন অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে সংগঠিত হয়েছিল। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ‘খুব দর্শনীয় অনুষ্ঠান’ হবে বলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই দিন শহরের অনেক জায়গায় নারীদের জনসভা হয়। নারী বক্তারা নারীদের আহ্বান জানান, ‘তাদের ঘোমটা অবিলম্বে খুলে ফেলতে’।এর পর নারীরা একে একে মঞ্চে ওঠেন।
তারা স্পিকারের সামনে তাদের পর্দা ছুড়ে ফেলে এবং পর্দা ছাড়াই রাস্তায় প্যারেড করতে বের হয়।ইতিমধ্যে এই ধরনের অন্যান্য প্যান্ডেলের ব্যবস্থা ছিল যেখানে সরকারী নেতারা এই মহিলাদের সংবর্ধনা করেছিলেন। ঘরে বসে থাকা অন্যান্য মহিলারাও বেরিয়ে এসে তাদের বোরকা ছুড়ে ফেলে প্যান্ডেলের দিকে যাওয়া মিছিলে অংশ নেন। সেই মিছিল ধর্মের শহর বোখারায় পরদা প্রথা ভেঙে দিয়েছিল। আরেকটি বিষয় হল যে অনেক মহিলা তাদের রাগান্বিত স্বামীর মুখোমুখি হওয়ার আগে আবার বোরকা পরেছিলেন। কিন্তু সেদিনের পর থেকে বোরকা কম দেখা যাচ্ছিল।
সোভিয়েত শক্তি নারীদের মুক্তির জন্য অনেক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। শিক্ষার প্রচার, আইনের প্রত্যেকের নিজস্ব ভূমিকা ছিল। যেসব স্বামী তাদের স্ত্রীকে হত্যা করেছে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য বড় ধরনের গণশুনানি হয়েছিল। এই নতুন প্রোপাগান্ডা কার্যগুলো বিচারকদের এই ধরনের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড আরোপ করতে উত্সাহিত করেছিল। পুরানো রীতিতে স্ত্রীকে হত্যা করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো না। রাশিয়ার মতো এখানেও নারীদের মুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হল নতুন শিল্পকরণ।
পুরাতন বুখারায় আমি একটি রেশম কারখানায় গিয়েছিলাম। এর পরিচালক ছিলেন একজন ফ্যাকাশে ক্লান্ত মানুষ যিনি এই নতুন শিল্পকে গড়ে তোলার জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কারখানায় লাভের আশা নেই। ‘আমরা তুর্কিস্তানের ভবিষ্যৎ সিল্ক কারখানার জন্য শ্রমিকদের প্রস্তুত করার লক্ষ্যে গ্রামের মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।আমরা জোর দিয়ে থাকি যে নারীরা বোরকা ছাড়াই কারখানায় কাজ করবে। এইভাবে, আমাদের কারখানা এমন একটি শক্তি যা সচেতনভাবে মহিলাদের মধ্যে বোরকা প্রথার অবসান ঘটাচ্ছে।
যখন কিশোরী টেক্সটাইল শ্রমিকরা বোরকা খুলে রাশিয়ান-শৈলীর হেডস্কার্ফ গ্রহণ করেছিল, তখন তারা এই ধরনের গানে তাদের জীবনের নতুন অর্থ প্রকাশ করেছিল:
যখন আমি কারখানার রাস্তায় গেলাম
সেখানে একটি নতুন রুমাল পেলাম
একটি লাল রুমাল, একটি সিল্ক রুমাল
নিজের হাতে শ্রম দিয়ে কিনেছি,
এখন কারখানার গর্জন আমার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়,
এটা আমাকে দেয় নতুন উদ্যম, নতুন ছন্দ,
এই রেশমি রুমাল, এই লাল রুমাল।
এই লাইনগুলো পড়তে পড়তে বারবাসের বৈষম্যমূলক ‘কামিজের গান’ এর লাইনগুলো মনে পড়ে। থমাস হুডের এই গানটিতে যুক্তরাজ্যের প্রথমদিকের কারখানার প্রাকৃতিক দৃশ্য বর্ণনা করা হয়েছে।
ক্লান্ত আঙ্গুল যার
চোখের পাতা লাল হয়ে গেছে যার
ছেঁড়া ন্যাকড়ায় লাল হয়ে যাওয়া সেই নারী
তার সূঁচে সুতো পরিয়ে যায়
সেলাই করে যায়, সেলাই করেই যায়
ক্ষুধা, দারিদ্র, নোংরার মধ্যে সেই নারী
তবুও উদাস সুরে গান গায়
সেই কামিজের
পুঁজিবাদী ব্রিটেনে কারখানাগুলো মুনাফার জন্য শোষণের একটি হাতিয়ার হিসাবে উপস্থিত হয়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নে, এগুলো কেবল সম্মিলিত সম্পদের একটি যন্ত্র ছিল না, বরং পুরানো শৃঙ্খল ভাঙ্গার জন্য সচেতনভাবে ব্যবহৃত একটি হাতিয়ার ছিল।
আনা লুইস স্ট্রং এর দ্য স্ট্যালিন এরা থেকে অনুবাদ
সময়োপযোগী এই লেখাটি প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ।