
তারাশংকর ভট্টাচার্য
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে উৎপাদনের “বন্ড গ্রাফ টেকনোলজি” ভেঙে দিয়ে পণ্যের মুনাফা বাড়ানোর জন্যে নিয়ে আসা হ’ল ‘ভ্যালু এডেড চেইন’ সিস্টেম । এর ফলে উৎপাদন খরচ কমাবার লক্ষ্যে কারখানাগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হ’ল কম মজুরীর দেশে মানে গরীব দেশে । সস্তার শ্রম , সস্তার কাঁচামাল, বাজার দখল করে প্রতিযোগিতায় টিকে পুঁজি বাড়াবার উদ্যোগ নেওয়া হ’ল । ফলে উৎপাদন কেন্দ্রগুলো উন্নত দেশ থেকে অনুন্নত দেশে চালান করা হ’ল । এতে দরিদ্র দেশগুলোর মানুষগুলো কাজ পেতে থাকল , হাতের কাছে বাজার পেতে থাকল । কিন্তু এতেও পুঁজির সঙ্কট মেটে না । বিশ্বায়নের নীতির সাথে সাথে একে একে ডাংকেল প্রস্তাব , গ্যাট চুক্তি , FDI এসে গেল । পৃথিবীর বেশীর ভাগ রাষ্ট্র এসব চুক্তি করতে বাধ্য হ’ল । এর মধ্যে সামাজিক উৎপাদনের সাথে যুক্ত হ’ল সেলফোন, ইন্টারনেট, কম্পিউটার ইত্যাদি ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস । যদিও এসবের প্রাথমিক ব্যবহার দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের পর রাশিয়া পূর্ব-ইউরোপ ব্যতিত অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে প্রযুক্তিগত প্রয়োজনে আসতে শুরু করেছে । ৮০-র দশকের পর থেকে তথাকথিত কমিউনিস্ট দেশগুলোকে পিছনে ফেলে মূলত আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলো উৎপাদনে প্রযুক্তি প্রয়োগ করে একদিকে যেমন বিশ্ব-বাজারকে দখল করল ,কমিউনিস্ট শিবিরের ধুঁকতে থাকা দেশগুলোতে পিছু হটতে বাধ্য করল বিশ্ব-বাণিজ্যে আর অন্যদিকে প্রযুক্তির ব্যবহারিক সুবিধার কারণে ক্রমশ সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যবদ্ধতার সুযোগকে বিনষ্ট করতে থাকল ।এরপর থেকে সারা বিশ্বে একমুখী পুঁজিবাদী শিবিরের মদতে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের অবসান ঘটিয়ে একচেটিয়া মাল্টি-ন্যশনাল, ট্রান্স-ন্যাশনাল,ইন্টার-ন্যাশনাল এমনকি স্টেটলেস কর্পোরেশানের জন্ম দিল ।২০০৮ সালে আমেরিকা সহ উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় ভয়াবহ মন্দা ঘনিয়ে এল , ব্যাঙ্ক সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হয়ে পড়তে লাগল । এই মহা-মন্দা সেইসব রাষ্ট্রগুলি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি । আমেরিকা তাই তাদের মন্দা অন্যদেশে চালান করার জন্যে চীনের সাথে ২০১৭ সাল থেকে শুল্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল , ১ম ও ২য় সশস্ত্র বিশ্বযুদ্ধের পরে ৩য় বিশ্বযুদ্ধ না হলেও চীন আমেরিকার এই শুল্ক-বাণিজ্য যুদ্ধে পৃথিবীর সব দেশই জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হ’ল । আর তারই ফলশ্রুতিতে ভারতের মতো সব দেশই মহা-মন্দার কবলে পড়ে গেল ।
এই অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে “গিগ ক্যাপিটালিজম” “ক্রোনি ক্যাপিটালিজম” এই নতুন ধরণের অর্থনীতির জন্ম । শ্রমবাজারেও এখন ‘গিগ অর্থনীতির’ (gig economy) প্রসার ঘটেছে। গিগ ইকোনমি হচ্ছে একধরনের খণ্ডকালীন কাজের ব্যবস্থা। সেখানে অনেক প্রতিষ্ঠান স্থায়ী কর্মী নিয়োগ না করে স্বল্প সময়ের জন্য কিছু বিশেষজ্ঞ কর্মী বিশেষ শর্তে নিয়োগ করে। তাঁদের কাজের ধরাবাঁধা সময় হয়তো থাকে না। কর্মী নির্দিষ্ট সময়ে চাহিদা অনুযায়ী কাজ করে দেন। সকালে হয়তো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি লেকচার দিলেন, দুপুরে কিছুক্ষণ উবার অ্যাপে যুক্ত হয়ে কয়েক ঘণ্টা কাজ করলেন, সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ আউটসোর্সিংয়ের কাজ করলেন। এটাই হলো গিগ ইকোনমি। এই গিগ ইকোনমির প্রচলনের ফলে পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৯৩ শতাংশ শ্রমজীবী মানষ ঠিকা শ্রমিক ।
ক্রোনি ক্যাপিটালিজম-এর অর্থ হলো, ঝুঁকির মাধ্যমে নয়, ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক নেতাদের হাত করে সরকারী সুবিধা নিয়ে ব্যাবসা বিরাট বড়ো করে ফেলছে। এখানে ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা অন্তরঙ্গ বন্ধু। আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজি টাইকুনদের সাথে জোটে অংশীদারীত্ব লাভের জন্যে দেশে দেশে ক্রোনি ক্যাপিটালি্টদের রমরমা, বিশেষ করে অনুন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে । আদানি আম্বানি এই ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের উদাহরণ । এরা দেশের সরকারের সাহায্য নিয়ে ধন-সম্পদ বাড়িয়ে একচেটিয়া পুঁজিবাদের শরিক হতে চায় । দেশের ৪০ জন বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ব্যাঙ্কের টাকা লুঠ করার পদ্ধতি ক্রোনি-ক্যাপিটালিজমের ফলশ্রুতি বলা যায় ।